“যুবলীগ হোক সৃজনশীল ও মেধাবীদের সংগঠন”

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  10:26 AM, 11 November 2022

নভেম্বর ১৯৭২- সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। সরকারবিরোধী সংগঠন হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের উত্থান হয়েছে সবে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা তাদের। ছাত্রলীগ এবং শ্রমিকলীগের নেতৃস্থানীয় অনেকেই বেরিয়ে গিয়ে যুক্ত হয়েছে তাদের সাথে। সর্বহারার উত্থানে যুবসমাজ উৎকণ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধ  ফেরত অসংখ্য কর্মহীন ছাত্র, যুবক ঘুরে বেড়াচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। জাসদের অপপ্রচার আর চটকদার বিজ্ঞাপনে অনেকেই যুক্ত হচ্ছে তাদের সাথে। জড়িয়ে পড়ছে উচ্ছৃঙ্খল কাজে, জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে। কর্মসংস্থানের অভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া এই বিপথগামী, বিশৃঙ্খল বিশাল যুবসমাজের  মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের জন্য একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, কিভাবে এই যুবসমাজকে দেশ ও জাতি গঠনের কাজে লাগানো যায়; কিভাবে যুবসমাজকে দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্বে আনা যায়। এই ভাবনা থেকেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার, মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম সংগঠক, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনিকে নির্দেশ দেন যুবকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার।
বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, লেখক, সাংবাদিক এবং একজন সুবক্তা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর তিনি “বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চার মূলনীতিকে ধারণ করে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র বিমোচন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং যুবসমাজের ন্যায্য অধিকারসমুহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে যুব কনভেশনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় যুবলীগ। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে যুবলীগের প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন শেখ ফজলুল হক মণি। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমেদ। প্রথম কংগ্রেসে নির্বাচিত চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি তার প্রথম মেয়াদ শেষ করার আগেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘাতকের নির্মম বুলেটে সস্ত্রীক নিহত হন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চরম বৈরি পরিবেশে ১৯৭৮ সালে আওয়ামী যুবলীগের দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে আমীর হোসেন আমু কে চেয়ারম্যান এবং ফকির আব্দুর রাজ্জাক কে সাধারন সম্পাদক করা হয়। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় কংগ্রেসে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে চেয়ারম্যান এবং রংপুরের ফুলু সরকারকে সাধারন সম্পাদক করা হয়। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলন, সংগ্রামে যুবলীগ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৬ সালের চতুর্থ কংগ্রেসে যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন শেখ ফজলুল হক মনির সহোদর শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং সাধারন সম্পাদক হন কাজী ইকবাল হোসেন। ২০০৩ সালের ৫ম কংগ্রেসে জাহাঙ্গীর কবির নানক কে চেয়ারম্যান এবং মির্জা আজম কে সাধারন সম্পাদক করা হয়। ওয়ান ইলেভেনের সেনা নিয়ন্ত্রিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং মির্জা আজম নেতৃত্বাধীন যুবলীগ।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর সংগঠনটির চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হলে ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে তিনি পুনরায় সভাপতি মনোনীত হন এবং সাধারন সম্পাদক হন হারুনুর রশীদ। তবে ২০১৯ সালের শুদ্ধি অভিযানে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত ওমর ফারুক চৌধুরী কে যুবলীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে একই বছরে যুবলীগের ৭ম কংগ্রেসে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির জ্যেষ্ঠ পুত্র শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ কে চেয়ারম্যান করা হয়। সাধারন সম্পাদক করা হয় মাইনুল হোসেন খাঁন নিখিল কে। তারা দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সহ সমগ্র পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় স্থবির হয়ে পড়েছিলো। পরশ-নিখিলের নেতৃত্বে করোনা মহামারীর সময় যুবলীগ সারাদেশে মানবিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সর্বমহলে প্রশংসিত হন।
সংগঠনটির লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী করোনা মহামারীর সময় মানুষকে সচেতন করার নিমিত্তে লিফলেট বিতরণ, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ, খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, বিনামূল্যে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঔষধ বিতরণ, ফ্রি অক্সিজেন ও এ্যাম্বুলেন্স সেবার ব্যবস্থাকরন সহ নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহন করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসহায় গরীব ও দুস্থ মানুষদের জন্য ফ্রী সবজি ও মাছের বাজার ও চালু করেন যুবলীগের অসংখ্য নেতৃবৃন্দ। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে যুবলীগ কর্মীরা নিজ উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করে ডাক্তার ও নার্সদের পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। করোনায় মৃত্যুবরণকারী মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, লাশের গোসল, জানাযা ও দাফন করানো সবই করেছেন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। অথচ সে সময় অনেক সন্তান এবং আত্মীয়, স্বজন ও করোনা আক্রান্ত পিতা, মাতা কিংবা স্বজনদের কাছে আসেন নি; জানাযা, দাফনে অংশগ্রহণ করেন নি। শুধু তাই নয়, যুবলীগের উদ্যোগে “আশ্রয়ন কর্মসূচি” এর আওতায়  সারাদেশে শত শত গৃহহীন মানুষকে গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
বাঙালির প্রতিটি সংকটে, সংগ্রামে, অর্জনে ও মানবিকতায় যুবলীগ ৫০ বছর ধরে তাদের পাশে আছে ছায়ার মত। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে জাসদ গণবাহিনী ও সর্বহারার নৈরাজ্য ও দেশবিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে যুবলীগ রুঁখে দাড়িয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও শেখ ফজলুল হক মনির নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের পর ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যুবলীগ নেতা বগুড়ার খসরু, চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দ জীবন দিয়েছেন। যুবলীগ কর্মি নূর হোসেন এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে জীবন দিয়ে অবৈধ শাসক জেনারেল এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে পুনরায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূত্রপাত হয়।
দেশের যুবসমাজের একটা বড় অংশ আজ মাদকের প্রতি আসক্ত। এদেরই একটা অংশ চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং খুন-খারাবির সাথে যুক্ত। এদের অনেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক দল কিংবা সংগঠনের ছত্রছায়ায় এরা বিভিন্ন অপকর্মের সাথে যুক্ত। সমাজের মানুষ এদের ঘৃণার চোখে দেখে। এদের কারনে সমাজের মেধাবী, শিক্ষিত, আদর্শিক, সৃজনশীল মানসিকতার ভিশনারী যুবসমাজের বড় অংশ রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখে।  যুবলীগের বর্তমান নেতৃত্ব বিশেষ করে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ “আই হেইট পলিটিক্স” প্রজন্মকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে বাঁধা মাদকাসক্তি। মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ীদের এবং আদর্শহীন পেশিশক্তি ও কালোটাকার মালিকদের যুবলীগের রাজনীতিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে সৃজনশীল, মেধাবী  ও শিক্ষিত তরুণ এবং যুবকদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে পারলেই যুবলীগের মিশন সফল হবে। বর্তমান ভিশনারী নেতৃত্বের হাত ধরেই তা সম্ভব বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
যুবলীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বশেষ ২০১৯ সালের সপ্তম কংগ্রেস পর্যন্ত কোনো কংগ্রেসই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে হয়নি। ৫০ বছরে যেখানে ১৭ টি কংগ্রেস হওয়ার কথা সেখানে হয়েছে মাত্র ৭ টি কংগ্রেস। যুবলীগের বর্তমান নেতৃত্ব ব্যর্থতার এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সংগঠনকে শক্তিশালী এবং গতিশীল করে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে অগ্রনী ভুমিকা পালনের উপযোগী হিসেবে সংগঠনকে গড়ে তুলবে বলেই এদেশের রাজনীতি সচেতন যুবসমাজের বিশ্বাস। শুধু যুবলীগের জাতীয় কংগ্রেস-ই নয়, জেলা, মহানগর, উপজেলা শহর, পৌর, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে ও সংগঠনকে গতিশীল এবং যুগোপযোগী করতে নিয়মিত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। আজ ১১ ই নভেম্বর যুবলীগের সুবর্ণজয়ন্তী। সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে যুবলীগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, যুবলীগের সফলতা, ব্যর্থতা কতটুকু তা পর্যালোচনা করে যুবআকাঙ্খা বাস্তবায়নে আগামীর করণীয় সম্পর্কে ১১ ই নভেম্বর সুবর্ণজয়ন্তীর যুবমহাসমাবেশ থেকে যুবসমাজের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা আসবে বলে আমার প্রত্যাশা। সবাইকে যুবলীগের সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখক:- মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।

আপনার মতামত লিখুন :