বঙ্গবন্ধু হত্যায়,ক্ষত বিক্ষত জাতির বিবেক

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  10:24 AM, 29 August 2023

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার দিকে। এই হত্যাকা-ের ওপর এজাহার ঢাকা নগরীর ধানমন্ডি থানায় ২ অক্টোবর ’৯৬ সালে দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর বাসস্থানে ’৭৫ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট তারিখে কর্মরত তার ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম। এর আগে ’৯৬-এর ২৩ জুন দেশে ঐ সালের ১২ জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ভিত্তিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজ জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে শঙ্কা ও নানাবিধ ‘প্রতিকূল অবস্থার’ কারণে এই এজাহার দিতে বিলম্ব হয় বলে মুহিতুল ইসলাম এজাহারের শেষাংশে উল্লেখ করেন। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে প্রধান ছিল ’৭৫ সালের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪১ দিন পর ’৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বেআইনিভাবে দেশের প্রেসিডেন্টের পদ দখলকার খন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক জারিকৃত এই অধ্যাদেশে একই সালের ১৫ আগস্টে ‘সরকার পরিবর্তন’ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ও কৃত ‘সকল কর্ম ও পদক্ষেপকে’ যে কোন অপরাধ থেকে দায়মুক্ত রাখা হয়েছিল। ’৯৬ সালের দায়মুক্তি (প্রত্যাহার) আইন (আইন নং ২১) দিয়ে সংসদ ’৭৫ সালের সেই কালো দায়মুক্তি অধ্যাদেশ রহিত করে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের দায় নির্ধারণ, বিচার করণ ও শাস্তি প্রদানের দৃশ্যত আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যে বৈরী জান্তা ও গোষ্ঠী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার হত্যার বিষয়ে কোনো এজাহার সংশ্লিষ্ট থানায় আইনানুগভাবে গ্রন্থিত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল।

বঙ্গবন্ধুর ৪ প্রধান সহযোগীকে জেলে অন্তরীণাবস্থায় খুন করিয়ে, হন্তারক সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের বিদেশী মিশনে কূটনৈতিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার মোড়কে পদোন্নত পদে নিযুক্ত করে, বঙ্গবন্ধুকে যে ভবনে খুন করা হয়েছিল তা সরকারি দখলে রেখে, তার সহকর্মী ও সহযোগীদের জেলে ঢুকিয়ে কিংবা তাদের প্রতিকূলে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরতান্ত্রিক জান্তা ঐ সময়ে তার হত্যার বিষয়ে এজাহার দেওয়া ও বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা অসম্ভব করে রেখেছিল। স্বৈরশাসক এরশাদের সময়ে এই হত্যার অন্যতম নায়ক কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও নেমেছিল। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একই কর্নেল ফারুক আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে ইচ্ছা করলে ৫ মিনিটে খুন করার সক্ষমতা তার আছে বলে জনসম্মুখে ঘোষণাও করেছিল। হত্যার ক্ষেত্রে খুনীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বাদী হয়ে মামলা চালনার বিধান ও দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও ’৯০-এ স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর খালেদার নেতৃত্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিএনপি সরকার এই হত্যাকান্ডের তদন্ত বা বিচারকরণ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

পরে বিচারের প্রক্রিয়ায় কতিপয় তাৎপর্যমূলক ও কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর ৪টি ঘটনা বা অপরাধের যথার্থ বিচার এখনো হয়নি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই রাতে মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে সপরিবারে বিপথগামী সেনাদের দিয়ে হত্যার বিষয়ে দেওয়া এজাহারের ভিত্তিতে ও পরবর্তীকালে এই বিষয়ে সমাপ্ত তদন্তের আলোকে এখনো তাদের হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়নি। একই সময়ে শেখ ফজলুল হক মনি ও আরজু মনির হত্যার বিষয়ে এজাহার দেওয়া কিংবা নেওয়া এবং তার ভিত্তিতে তদন্ত হয়েছিল কিনা এখনো জানা যায়নি। এদের হত্যাকা-ের জন্য দায়ী কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর হত্যার দায়ে শাস্তি পেলেও সকল হত্যা ও সহায়তাকারীর বিচার হয়েছে বলা যায় না। ’৭৫ সালের সেই কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্রক্রিয়ায় ট্যাঙ্ক থেকে ছোড়া কামানের গুলিতে মোহাম্মদপুরে জনৈক রিক্সা চালক ও বিয়ের গায়ে হলুদ নেওয়া এক যুবকের নিহত হওয়া, আরও ১২ পথচারী ও বাসায় অবস্থানরত সাধারণ নাগরিকদের গুরুতরভাবে আহত এবং বাংলাদেশ টিভির সদর অফিসে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দিয়ে খুন বা গুম হওয়া দুজন কর্মকর্তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কোনো তদন্ত হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। চার জাতীয় নেতাকে ’৭৫ এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলে হত্যাকরণের বিচার ২০০১-এর অক্টোবরে সরকার পরিবর্তনের পর সুষ্ঠুভাবে হাতে নেওয়া এবং আসামিদের যথার্থ শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে ঐ সরকারের তরফ হতে ঈপ্সিত প্রচেষ্টা প্রযুক্ত হয়নি। এই প্রক্রিয়ার যারা প্রতিরোধী ছিলেন তাদের এখনো শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা যায়নি। তেমনি ’৭৫-এর নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ও একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩ জন অফিসার খুন করার কোনো তদন্ত ও বিচার এখনো হাতে নেওয়া হয়নি। বলা প্রয়োজন হত্যার বিচার সমাজে শক্তির মদমত্ততায় বাধা দেওয়া বা অস্বীকার করার এরূপ ঘটনা সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের হানি করে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের বিচারে প্রদত্ত সাক্ষ্য ও উত্থাপিত কাগজপত্রে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম বারবার এসেছে। ’৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট আফজালুর রহমানের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লেঃ কর্নেল রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদ কর্তৃক প্রদত্ত স্বীকারোক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ও নায়ক মেজর রশীদ, মেজর ফারুক ও অন্যদের সঙ্গে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যোগাযোগ রাখত। তার বিবৃতি অনুযায়ী ঐ সময়ে ষড়যন্ত্র করার একরাতে মেজর ফারুক মেজর জেনারেল জিয়ার বাসা থেকে ফিরে মেজর রশীদকে জানায় যে, সরকার পরির্বতন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়। জেনারেল জিয়া নাকি এই প্রসঙ্গে তাদের বলেছিল যদি এ (ষড়যন্ত্র) সফল হয় আমার কাছে এসো, না হলে আমাকে সংশ্লিষ্ট করো না। এর ক’দিন পর মেজর ফারুক জেনারেল জিয়ার বরাত দিয়ে মেজর রশীদকে বলে যে জিয়া ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কাজ করার লক্ষ্যে এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খুঁজতে বলেছে যে দায়িত্ব নিতে পারবে। এরপর মেজর রশীদ তার আত্মীয় খোন্দকার মোশতাককে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্ট করে। জোবায়দা রশীদ আরও বলেন, (১৯৭৫ সালের) ১৫ আগস্ট বিকালেই বঙ্গবভনে জেনারেল জিয়াউর রহমান মেজর রশীদের কাছে সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য ঘুর ঘুর করছিল। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে রক্ষা করতে সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। বিচারক গোলাম রসুল তার রায়ে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন, এক্ষেত্রে মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয়েছে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ, বিশেষ করে যারা ঢাকায় পদস্থ ছিলেন, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি, এমনকি পালনের কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করেননি। তার মতে, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য এটি ‘চিরস্থায়ী কলঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের হত্যার বিচারে বিচারক গোলাম রসুলের এরূপ অবস্থানের প্রেক্ষিতে এও বলা প্রয়োজন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার মুখ্য নিরাপত্তা অফিসার মহিউদ্দিন আহমেদ, তার বাসায় কর্মরত হত্যার চাক্ষুস দর্শক পুলিশ অফিসার নুরুল ইসলাম খান (সাক্ষী ৫০) কিংবা তার ব্যক্তিগত অফিসার বৃন্দ খুনের পর এজাহার দিতে এগিয়ে আসেনি। আইন অনুযায়ী খুন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন ঢাকা নগরের পুলিশ সুপার, ঢাকা জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের মহাপরিদর্শক বা স্বরাষ্ট্র সচিব বঙ্গবন্ধুর বিদিত হত্যার বিষয়ে কোনো প্রতিকার বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। অবশ্য ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দীন আহমেদকে (বীরবিক্রম) বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পরই সামরিক জান্তা গ্রেফতার ও চাকরিচ্যুত করে। বেশ সময় থেকে হয়ে আসা হত্যার ষড়যন্ত্র বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে তেমনি ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশের বিশেষ বিভাগ ও সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানগণ। ফলতঃ হত্যাকান্ডের ২৩ বছর পর এদের চেয়ে নিম্নতর পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলামকেই এগিয়ে এসে এজাহার দিতে হয়েছিল। দৃশ্যত একমাত্র মাহবুবউদ্দীন (বীরবিক্রম) ছাড়া অফিসার সুলভ সাহসের অনুপস্থিতি এসব অফিসারদের ক্ষেত্রেও চিরস্থায়ী কলঙ্কের তিলক হয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত সকল অফিসার স্মর্তব্য থাকবে।

রাষ্ট্রপক্ষের তরফ হতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। তাকে সহায়তা করেন তার সুযোগ্য পুত্র এই সময়ের আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলের পরের দিকে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ও আনিসুল হক উচ্চতর আদালতে হত্যা মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পান। ২০০২ সালে অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক মারা যান এবং ২০০৩ সালে অ্যাডভোকেট আনিসুল হক খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কালের বৈরী পরিবেশের কারণে জেলহত্যা মামলার সরকারি আইনবিদ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নিম্ন আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে এরূপ বিচার প্রতিকূল বৈরী পরিবেশ যারা সৃষ্টি করেছিল নিঃসন্দেহে তারা আইনের যথার্থ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছিল। এদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের হত্যা মামলায় আসামি পক্ষে প্রধান আইনবিদের ভূমিকা নেয় এডভোকেট খান সাইফুর রহমান। তার সঙ্গে ছিল সর্ব অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক, টি এম আকবর, নজরুল ইসলাম ও শরফউদ্দিন মুকুল। জোট সরকারের শাসনামলে (২০০২-২০০৮) আবদুর রাজ্জাক খান অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের এবং খান সাইফুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ মামলা সমূহ পরিবীক্ষণ সেলের আইনি উপদেষ্টার পদ লাভ করে। এসব তাৎপর্যপূর্ণ ও কৌতূহল উদ্দীপক উদ্ঘাটিত তথ্য অনুগমন করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের ফলে যারা লাভবান হয়েছিল এবং এই হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় যারা ইচ্ছা করে বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি বা অহেতুক প্রলম্বন কিংবা হত্যাকারীদের সুরক্ষা ও প্রতিপালনে সক্রিয় ছিল তাদের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন। দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করতে যে বা যারা ভূমিকা রেখেছিল, বিশেষতঃ এই লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের আইনী খসড়া তৈরির দায়িত্ব বা কর্মকর্তার ভূমিকায় থেকে এই অধ্যাদেশটির খসড়া যে বা যারা তৈরি করেছিল, তা সংসদ কর্তৃক পাস করানোর মন্ত্রণা দিয়েছিল এবং সংসদে যারা বিনাবাক্যে দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে সমর্থন করেছিল আর ফলত এই সব হত্যার বিচার বন্ধ রাখার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, তাদের স্বরূপ এই দেশে ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ স্থাপনের স্বার্থে বের করা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে ও লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার আদল অনুযায়ী একটি সত্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে। কেবল শাস্তি আরোপন নয়, প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনের মাধ্যমে সামাজিক আত্মশুদ্ধির অবকাশ এই ধরনের পদক্ষেপ জাতিকে দেবে বলে আশা করা যায়।

বিচারপতি করিম ২৫ কর্মদিবসে বিষয়টির ওপর শুনানি নিয়ে ২০০১ এর ৩০ এপ্রিল ঐ ৫ জন আসামির মধ্যে ৩ জন, নামতঃ মেজর আহমদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশিম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসারকে অপরাধ সংঘটন প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয়তার বা সংশ্লিষ্টতর বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রমাণের অনুপস্থিতির কারণে মৃত্যুদন্ড থেকে রেহাই দেন। এই রেহাই দানের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি এই বিষয়ে বিচারপতি মো. রুহুল আমীনের সঙ্গে অংশত ঐকমত্য পোষণ করেন। আর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের মতের সঙ্গে অংশত একমত হয়ে তিনি লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদ- দৃঢ়ীকৃত করেন। ফলতঃ জেলা ও দায়রা বিচারক কাজী গোলাম রসুল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ১৫ জন আসামিদের মধ্যে হাই কোর্ট ডিভিশন কর্তৃক ৩ জন, নামতঃ মেজর আহমদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ছাড়া বাকি ১২ জন দেশের প্রচলিত আইনে দৃঢ়ীকৃতভাবে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত থাকেন। এদের মধ্যে পলাতক আসামির ক্ষেত্রে প্রদত্ত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আইনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিলাত বিভাগে কোনো আপিল করা হয়নি বিধায় তাদের ওপর আরোপিত মৃত্যুদন্ড ইতোমধ্যে দৃঢ়ীকৃত ও চূড়ান্ত হয়ে আছে। তাদেরকে গ্রেফতার করে দেশে প্রত্যার্পণ করিয়ে মৃত্যুদ- এখনই কার্যকর করা যায়। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত জোট সরকার এসব পলাতক আসামিকে গ্রেফতার করে দেশে এনে তাদের ওপর আরোপিত মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

হাই কোর্ট ডিভিশন কর্তৃক চূড়ান্তভাবে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত কারারুদ্ধ আসামিদের মধ্যে ৮ জন সুপ্রিম কোর্টের আপিলাত বিভাগে তাদের ওপর আরোপিত ও দৃঢ়ীকৃত দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলা নিষ্পত্তিকরণে আপিলাত বিভাগের ৩ জন বিচারক নামতঃ বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী, বিচারপতি এম এম রুহুল আমীন ও প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেন এই বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে বিব্রত বোধ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। আপিলাত ডিভিশনে তখন পদোন্নত বিচারপতি মো. রহুল আমীন ও বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ইতোমধ্যে এই হত্যাকান্ড উৎসারিত ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতির ভূমিকায় সম্পাদন করেছিলেন। এই কারণে আপিলাত বিভাগের এই দুজন বিচারপতি এদের আপিল নিষ্পত্তি করতে পারেননি। ফলত এই বিষয়ে বিব্রত বোধ-না-করা একজন বিচারপতি, নামত, প্রধান বিচারপতি তফাজ্জল ইসলাম আপিলাত বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী এই ডেথ রেফারেন্স বিষয়ক আপিল নিষ্পত্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হন। কিন্তু আপিলাত বিভাগে গঠিতব্য পূর্ণ বেঞ্চে এই সব আপিল নিষ্পত্তিকরণে ৩ জন বিচারপতির প্রয়োজন ছিল।

হাই কোর্ট বিভাগ থেকে আপিলাত বিভাগে এডহক ভিত্তিতে ২ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ করে এইসব আপিলের নিষ্পত্তি হতে পারত। সংবিধান (অনুচ্ছেদ ৯৮) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে এই নিয়োগ দিতে পারেন। তৎকালীন জোট সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী মওদুদ তখন বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মাত্র ১ জনকে এডহক ভিত্তিতে আপিলাত বিভাগে নিযুক্তি দিতে পারেন। তার মতে একজনকে এভাবে এডহক ভিত্তিতে আপিলাত বিভাগের বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি নিয়োগ করলে এই মামলার নিষ্পত্তির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গঠন করা যায় না, দুজনের প্রয়োজন হবে। মওদুদ আহমদের মতে এই কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পদোন্নয়নের মাধ্যমে আপিলাত বিভাগে আরও দুজন বিচারপতি নিযুক্ত না হলে এসব আপিলের নিষ্পত্তি করা যেত না। মওদুদের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী হাই কোর্ট বিভাগ থেকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিব্রত-না-হওয়া দুজন বিচারপতির পদোন্নয়ন ঘটার আগে সম্ভবত প্রধান বিচারপতি তফাজ্জল ইসলাম অবসরে চলে যেতেন। ফলত বঙ্গবন্ধুর হত্যার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত খুনিরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যেতে পারত। আইনের মোড়কে মওদুদের এইরূপ কৌশলীয় অবস্থান তার সরকারের ২০০৮ সালে পরাজয়ের পর গ্রহণ করা যায়নি। তখন আইনবিদদের সযতœ বিবেচনায় সংবিধান অনুযায়ী একাধিক বিচারপতি এডহক ভিত্তিতে আপিলাত বিভাগে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতির সুপারিশ বিবেচনায় এনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে নিযুক্ত হতে পারেন বলে স্থিরিকৃত হয় এবং এভাবে দুজন বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার পর এই বিচারিক প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে বিব্রত-না-হওয়া আর একজন বিচারপতিসহ এই মামলার জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গঠন করা হয়। প্রধান বিচারপতি তফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায় অনুযায়ী ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ৫ আত্মস্বীকৃত খুনি নামতঃ কর্নেল ফারুক রহমান, কর্নেল শাহরিয়ার রশীদ খান, লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ, মেজর একে বজলুল হুদা ও মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমদের মৃত্যু দন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে মেজর এ কে এম মহিউদ্দিনকে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক আশ্রয় না দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছিল। এরপর মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আরেক পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন মাজেদ দেশের অভ্যন্তরে ধরা পড়লে তার মৃত্যু দন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।

মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত বাকি ৬জনের মধ্যে একজন, নামত আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুইয়েতে অবজ্ঞা ও অবহেলার আবহে মারা যায়। আর বাকি ৫ জন, নামতঃ লেঃ কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর শরীফুল হক ডালিম, কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর এ এইচ এম বি নুর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দীন খান এখনো পর্যন্ত ধরা পড়েনি। এদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নুর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। পলাতক দন্ডপ্রাপ্তদের আইন অনুযায়ী সহায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পদক্ষেপ এখনো নেওয়া হয়নি। রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবরণে অবস্থান সে দেশের সরকার পর্যায়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তবিহীন অবস্থায় আছে।

এই বিষয়ে যথা আইনি সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য সে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে খুনিকে সে দেশে আশ্রয় না দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে এ কে এম মহিউদ্দিনের মতো বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবেন বলে আশা করা যায়। কানাডায় অবস্থানরত মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি নুর চৌধুরীকে মৃত্যু দন্ডাদেশ দেওয়া দেশে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে পাঠানোর ওপর আইনি পর্যালোচনা হয়েছে। জাতি বিশ্বাস করে, যে দেশ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের গোপনে আশ্রয় দিয়ে লালন করছে তারা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না এবং তাদের সঙ্গে এই কারণে সম্পর্ক ছেদ করতে দ্বিধাগ্রস্ত না হওয়া অমূলক হবে না।

লেখক : সংসদ সদস্য, ​​​​​​​ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক মন্ত্রী।

আপনার মতামত লিখুন :