মেহেরপুরে ঋণ পরিশোধ না করায় জেলে গেলো নারী-৮

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  09:32 PM, 15 September 2022

মেহেরপুরে সৃজনী ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পারায় দরিদ্র ৮ নারীকে যেতে হলো জেল হাজতে। এসব নারীদের নামে এনজিও “সৃজনী ফাউন্ডেশনের” দায়ের করা মামলায় আদালত গ্রেফতারী পরোয়ানাজারি করে।

আদালতের পরোয়ানা পেয়ে মেহেরপুর সদর থানা পুলিশ গতকাল বুধবার সকালের দিকে আমদহ গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করেন।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন, মেহেরপুর সদর উপজেলার আমদহ গ্রামের হেলাল উদ্দীনের স্ত্রী ছবি খাতুন, আশাদুল হকের স্ত্রী তোকিয়ারা খাতুন, রবিউল ইসলামের স্ত্রী সাথিয়ারা খাতুন, মো: লিটন মিয়ার স্ত্রী ফারজিনা খাতুন, আসাদুল ইসলামের স্ত্রী নুরজাহান খাতুন, আনারুল ইসলামের স্ত্রী সাবুন্নারা খাতুন, মোসাররফ হোসেনের স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন ও ফরমান আলীর স্ত্রী সাহিদা খাতুন।

সৃজনী ফাউন্ডেশনের পক্ষে মেহেরপুর শাখার তৎকালিন ব্যবস্থাপক সাইদুর রহমান বাদী হয়ে মেহেরপুর কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং সিআর ৫১৬/২২। এই মামলায় এসব অসহায় গ্রামীণ নারীদের গ্রেফতার করে পুলিশ।
বর্তমান শাখা ব্যবস্থাপক শাজাহান কবীর বলেন, সদর উপজেলার আমদহ গ্রামে জবা মহিলা সমিতি নামের ওই সংগঠণে মোট ৪০ জন সদস্য রয়েছে। এসব সদস্যের মধ্যে ছবি খাতুন ৪৯ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন ৪০ হাজার টাকা। এখনো তার কাছে সমিতি পাবে ৯ হাজার টাকা, তোকিয়ারা খাতুন সমিতির কাছ থেকে ৪৬ হাজার টাকা ঋণ নেন। সেও ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। এখনো বাকী রয়েছে ৬ হাজার টাকা। নুরজাহান খাতুনও ৪৯ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছে ১০ হাজার টাকা। তার কাছে পাওয়া যাবে ৪০ হাজার টাকা। সাথিয়ারা খাতুন ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন মাত্র ৩ হাজার টাকা। ফারজিনা খাতুন ৪৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন ২৮ হাজার টাকা, সাবুন্নারা খাতুন ৪৯ হাজার টাকা ঋণ নিলেও পরিশোধ করেছেন ১৬ হাজার টাকা, আনোয়ারা খাতুন ৪৯ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পেরিশোধ করেছেন ৫ হাজার টাকা ও সাহিদা খাতুন ৪৯ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছেন ৪০ হাজার টাকা।আমদহ জবা মহিলা সমিতির এই ৮ জন সদস্য ঋণের কিস্তি পুরো পরিশোধ না করায় তাদের নামে আদালতে মামলা দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো জানান, সৃজনী ফাউন্ডেশনের মেহেরপুর শাখার আওতায় মোট ৪০টি সমিতির প্রায় ৪০০ সদস্য রয়েছে। গ্রামের এই সমিতিগুলোর মধ্যে ২৭ জন সদস্য বিভিন্ন সময়ে ঋণ তুলে পরিশোধ করতে না পারায় তাদের নামে সংস্থার উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে আদালতে মামলা দেওয়া হয়েছে।এদিকে আমদহ গ্রামের এই ৮ নারী আটক হওয়ার পর সৃজনী ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন এলাকার সমিতির খেলাপি অসহায় নারীরা সমিতির কার্যালয়ে এসে ভীড় জমিয়েছেন।

রাজাপুর গ্রামের মহসিন আলীর স্ত্রী মোমিনা খাতুন ও আমিনুল ইসলামের স্ত্রী আলেয়া খাতুন বলেন, আমরা ঋণ নিয়ে করোনার কারণে ঠিকমত কিস্তি দিতে পারিনি। আজকে আমদহ গ্রামের ৮ নারীকে হাজতে পাঠানোর পর থেকে সমিতির সদস্যদের মধ্যে আতংক তৈরী হয়েছে। তাই সমিতির অফিসে মিটমাট করতে এসেছি।

নিয়ম কানুন মেনে ঋণ দেওয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক আলিফ খান বলেন, যাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে তারা ৫ থেকে ৬ বছর আগে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করেনি। মামলার আগে ঋণ আদায়ের জন্য তাদের সাথে সব ধরনের আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তারা লোন পরিশোধ না করে আমার কর্মিদের সাথে অসাদাচারণ করেছে। এজন্য তাদের নামে মামলা করতে বাধ্য হয়েছি।

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাজতে যাওয়া নারীদের স্বজনরা জানান, ঋণের অধিকাংশ কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। বিগত দিনে করোনার কারনে আমাদের কিস্তি দিতে পারিনি। আমরা একটু স্বচ্ছল হয়ে কিস্তি পরিশোধ করার কথা বলা হলেও তারা আমাদের নামে মামলা করেছে। সরকার যখন সমাজে নারীদের উন্নয়ন এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে, এমন সময় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা “সৃজনী ফাউন্ডেশনের” অমানবিক কার্যকলাপে বিস্মিত সুশীল সমাজের নাগরিকগণ।

জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মেহেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জাকির হোসেন বলেছেন যাদের দ্বারা সামান্য ঋণের দায়ে অসহায় নারীদের মামলার জালে ফেলে জেলে যেতে হয়। তাদের দ্বারা নারীদের সামাজিক উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। বিষয়টিকে হাস্যকর আখ্যা দিয়ে সৃজনী বাংলাদেশ এনজিওকে বয়কটের আহবান জানান তিনি। এই এনজিও দ্বারা কিভাবে গ্রামীণ নারীদের উন্নয়ন সম্ভব সে প্রশ্নও তুলে সৈয়দ জাকির হোসেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

করমদি ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক এএসএম সায়েম পল্টু বলেন, দারিদ্রতার চক্র থেকে বেরিয়ে স্বাবলম্বী হতে অনেকেই এনজিওগুলো থেকে ঋণ নেন। কিন্তু দেখা যায় ঋণের কিস্তি শোধ করতে আবার অন্য একটি এনজিওর ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। সেই ঋণের জাল থেকে আর বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়না।এক সময় তাদের ভিটেমাটিও বিক্রি করতে দেখা যায়। অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েও গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনজিও সমিতির একজন নেতা বলেন সরকারের এমআরএ নিয়মনীতি মেনে ঋণ দেওয়া উচিৎ। হয়তো ওই এনজিওর সাথে গ্রাহকদের চুক্তি ভঙ্গের কারণে মামলা করেছে। তবে, কোনো গরীব নারীদের হয়রানি না করে বিষয়টি অন্যভাবে সুরাহা হওয়া উচিৎ ছিল। তিনি বলেন, আমার এনজিও’র অনেক গ্রাহক খেলাপি রয়েছে। আমি এসব অসহায় গরীব নারীদের নামে মামলা করে হয়রানি করিনি। এটা এনজিও গুলোর উদ্দ্যেশ্য নয়। এনজিওগুলোর উদ্দ্যেশ্য পিছিয়ে পড়া অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী করা।

ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়কারী ফজলুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ খেলাপিদের মামলা দিয়ে হয়রানি না করে তাগাদার মাধ্যমে আদায় করা হয়। আমাদের কর্মীদের সে ধরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গাংনী সরকারী ডিগ্রী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আব্দুর রশিদ বলেন, এনজিওগুলো যেন গরিবের রক্ত শোষণের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক এনজিও সঠিক নিয়মকানুন অনুসরণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এনজিওগুলো কাগজে–কলমে ১০ শতাংশ সুদের কথা বললেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছে। তারা অসহায় দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করার নামে আরও দরিদ্র করছে।

আপনার মতামত লিখুন :