ভাষা সৈনিক শওকত আলীর মত নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, আদর্শিক নেতার রাজনীতিতে এখন বড়ই অভাব

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  01:01 PM, 19 April 2022

শওকত আলী কেবল একটি নাম নয়, বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাসের অন্যতম প্রধান উপাদান। দেশ এবং জাতির প্রয়োজনে একজন মানুষ কতটা নির্লোভ, নিঃস্বার্থ এবং নিবেদিতপ্রাণ হতে পারেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমদ এরপরে সম্ভবত ৫২’র ভাষা সংগ্রামী শওকত আলী’ই তার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন ইতিহাসের অন্যতম প্রধান নির্মাতা হয়েও বরাবরই নিজেকে আড়াল করে গেছেন ইতিহাস থেকে। ইতিহাসে শওকত আলীর নামটি না যতটা উজ্জ্বলভাবে উচ্চারিত হয়েছে, তার ১৫০ মোগলটুলির বাসভবনটি তার চেয়ে বেশি আলোকিত করেছে ইতিহাসকে। মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার অন্যতম চিন্তক এবং পরিকল্পক  ছিলেন শওকত আলী।

আওয়ামীলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভাষাসংগ্রামী শওকত আলীকে বর্তমান ইতিহাসবিমুখ রাজনীতিকদের কয়জন চেনে? বর্তমান প্রজন্ম কি চেনে তাকে? জানে এই দেশ এবং জাতির জন্য তার অপরিসীম আত্মত্যাগের সমৃদ্ধ ইতিহাস? বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে নেতুত্ব দেওয়া চার জাতীয় নেতার সম্পর্কেই জানে না বর্তমান প্রজন্মের সিংহভাগ! এই দৈন্যতা আসলে কার? সমাজ, রাজনীতি আর  প্রজন্মের এই সীমাহীন অবক্ষয় এই প্রজন্মের একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মি হিসেবে আমাকে প্রতিনিয়ত পীড়া দেয়। নিজের বিবেক তাড়িত করে হাতে কলম তুলে নিতে, ইতিহাসের নায়কদের সংগ্রামী জীবনগাঁথা তুলে ধরতে। ইতিহাস থেকে বিস্মৃত বহু ইতিহাসের স্রষ্টা শওকত আলী কে নিয়ে আমার এই আর্টিকেলটি বিবেকের তাড়নায়।

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাসখানেক পর ঢাকা এসে শওকত আলীর ১৫০ মোগলটুলির বাসভবনে বসেই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার সকল কর্মকান্ড সম্পাদন করেন। ১৯৪৩ সালে কুষ্টিয়ায় মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যখন ক্ষমতাসীনদের পদলেহনই হয়ে উঠেছিল নেতৃত্বের একমাত্র যোগ্যতা, একমাত্র মাপকাঠি সেদিনই তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব বিকল্প ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। পরবর্তীতে লেখাপড়ার প্রয়োজনে কলকাতা গেলেও সেখানে বসেই নতুন বিরোধী ছাত্রসংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতা থেকে মাঝেমাঝে ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধু শওকত আলীর ১৫০ মোগলটুলির বাসায় উঠতেন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সদস্যদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনায় মিলিত হতেন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমর্থক বঙ্গবন্ধু, আওয়ামীলীগ এবং ছাত্রলীগের গোড়াপত্তন শওকত আলীর ১৫০ মোগলটুলির ঐতিহাসিক বাড়ীতে! যে আওয়ামীলীগকে জন্ম দিয়েছেন, শৈশবে লালনপালন করেছেন পিতৃ এবং মাতৃস্নেহে- চাইলেই সেই আওয়ামীলীগের অনেক বড় নেতা হতে পারতেন কিন্তু কখনই হননি।  অন্যরা যখন নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত, তখন দেশ এবং জাতির জন্য অনেক কিছু করেও নিজেকে সবমসময় আড়াল করেছেন আত্মপ্রচারবিমুখ এই দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ।

পিতা ঢাকার গেন্ডারিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শমসের আলী এবং মাতা মেহেরুননেসা খাতুনের কোল আলো করে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল এই ধরাধামে আবির্ভাব ঘটেছিল শওকত আলীর। মাত্র দু’বছর বয়সে মাতাকে হারান। পুরানো ঢাকার রায়সাহেব বাজারে মামা-মামীর বাড়ীতে শৈশব কাটে তার। মাঝেমাঝে দাদার কাছেও থাকতেন তিনি। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন শওকত আলী। তবে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে সম্পন্ন করতে পারেননি। ১৯৬১ সালে শিক্ষানুরাগী ও নারীনেত্রী  নারায়নগঞ্জের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে রহিমা খাতুনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

শওকত আলীর বিয়ে ছিল ঢাকাবাসীর জন্য “টক অব দ্যা টাউন”। তিনি যেদিন বিয়ে করতে বরযাত্রী নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যান, সেদিন ঢাকা সিটি প্রায় ট্যাক্সী শূন্য হয়ে পড়েছিল। সব ট্যাক্সির গন্তব্য ছিল সেদিন নারায়নগঞ্জ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীন আহমদ সহ অসংখ্য নেতাকর্মী এবং ঢাকাবাসী বিয়ের বরযাত্রীতে শরিক হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বোমা ব্যবসায়ী শওকত আলীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঢাকার চকবাজারের সোলায়মান সাহেব বিশেষ কিছু আতশবাজি বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিয়েতে। সবকিছু ছাপিয়ে বিয়েতে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন প্রধান আকর্ষণ তার আধুনিক এবং দামি আতশবাজি ফুটানোর জন্য।

শুধু তার বিয়েতেই নয় পারিবারিক প্রায় সকল অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধু সহ গুরুত্বপূর্ণ সকল নেতারা আসতেন শওকত আলীর বাড়ীতে। শওকত আলীর দুই পুত্র তাদের সুন্নতে খতনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে খুব সুন্দর চামড়ার স্কুল স্যুটকেস উপহার পেয়েছিলেন বলে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
তাদের তিন পুত্র সালাহউদ্দিন আহমেদ আজাদ, মহিউদ্দিন আল আমান শাহেদ, কামালউদ্দিন আহমেদ পিয়াল এবং একমাত্র কন্যা শরমিন শম্পা।

ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ এবং ভাষাসংগ্রামী শওকত আলী তিনটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদেরই সদস্য ছিলেন। আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার শুরুতে ঢাকা মহানগর আওয়ামীলীগের মূখ্য সংগঠক ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ১৫০ মোগলটুলির বাসস্থানটি ছিল ভাষা আন্দোলন এবং বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সকল নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীবাহিনীর মিলনক্ষেত্র। মুসলিম লীগের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই এখানে কর্মী শিবির গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কামরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মোঃ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা প্রমুখ কর্মী শিবির কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন।

মুসলিম লীগ কর্মি শিবিরের প্রধান নেতা ছিলেন শামসুল হক। ভাষা সৈনিক এবং ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি মেধাবী ছাত্রনেতা এ্যাডঃ দবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হেবিয়াস কপার্স মামলায় তার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনার জন্য শওকত আলীর অনুরোধে কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। শওকত আলী এ পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার উদ্যোগে তার ১৫০ নং মোগলটুলির বাসভবনে এবং কর্মী শিবির অফিসকে ঘিরে বেশ কয়েক মাস ধরে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতা চলে।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকা এলে তার সঙ্গে শওকত আলীর আলোচনা হয়। শওকত আলী মাওলানা ভাসানীকে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জানান। এই আলোচনার সূত্র ধরে নতুন দল গঠনের জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন শওকত আলী। সেজন্যে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মাওলানা ভাসানী সেই বৈঠকে যোগদান করেন।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক করে অন্যদেরসহ একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।
উপর্যুক্ত সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক কর্মি সম্মেলন আহ্বান করে। বশীর হুমায়ুনের মালিকানাধীন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের ঐতিহাসিক ‘রোজ গার্ডেন’ প্যালেসে ২৩ জুন বিকেল তিনটার সেই সম্মেলনেই ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজকের প্রজন্ম যখন জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস পাঠকে নিছকই সময়ের অপচয় মনে করে, রাজনীতিবিদরা যখন তার পূর্বসুরিদের স্মরণ করতে হীনমন্যতায় ভোগেন তখন ও আলোর দিশারী হয়ে পথ দেখান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তার “অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় লাইনে লাইনে তুলে ধরেছেন শওকত আলীর নির্মোহ ত্যাগ, অবদান আর বীরত্বগাঁথা। বঙ্গবন্ধুর লিখে যাওয়া অমূল্য দলিলেই ফুটে উঠেছে দেশপ্রেমিক শওকত আলীর জীবন ও কর্ম।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি লিখেছেন-

১৫০ মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করেন। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমারও বন্ধু। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করলাম, ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে পৌঁছে দিতে। দেখলাম, রসিক গাড়োয়ান মোগলটুলী লীগ অফিস চেনে।”

আমাকে বললো, “আপনি লীগ অফিসে যাইবেন, চলেন সাব আমি চিনি।” পয়সাও বেশি নিল বলে মনে হল না। অনেক গল্প শুনেছি এদের সম্পর্কে। কিন্তু আমার সাথে দর কষাকষিও করল না। শামসুল হক সাহেব ও শওকত সাহেব আমাকে পেয়ে খুবই খুশি। শওকত আমাকে নিয়ে কি যে করবে ভেবেই পায় না। তার একটা আলাদা রুম ছিল। আমাকে তার রুমেই জায়গা দিল। আমি তাকে শওকত ভাই বলতাম। সে আমাকে মুজিব ভাই বলত।”

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস ও ছিল শওকত আলীর ১৫০ মোগলটুলির বাসভবনে। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন-

“মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মোগলটুলি। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেন নাই। আমরা ‘মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নাম দিয়ে সাইন বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসও করা হল। শওকত মিয়া টেবিল, চেয়ার, আলমারি সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল। তাকে না হলে, আমাদের কোন কাজই হত না তখন। আমরা যে কয়েকজন তার সাথে মোগলটুলিতে
থাকতাম, আমাদের খাওয়া থাকার ভার তার উপরই ছিল। মোগলটুলিতেই ন্যাশনাল গার্ডের অফিস করা হয়েছিল। তিনতলা বাড়ি, অনেক জায়গা ছিল।”

১১ মার্চ, ১৯৪৮ দিনটিকে ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রথম হরতাল আহবান করেছিল। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এটিই ছিল আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচী। ১১ ই মার্চ সম্পর্কে  বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন-

১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ করা হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেক দল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিং এর সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার (এখন নওগাঁর এডভোকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ গুরুতররূপে আহত হল। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেক ছাত্র আহত হল। আব্দুল গনি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়ছে।”

অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের প্রথম মিছিলেই আহত হন শওকত আলী।
পরবর্তীতে ১৬ ই মার্চ ও আহত হন তিনি। একবার, দুইবার নন ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশিবার নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তিনি। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠায় ও শওকত আলীর অনবদ্য ভূমিকা ছিল যা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করলে জানা যায়। আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। ২৩ জুনের ‘রোজ গার্ডেন’ এর কর্মি সম্মেলন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-

“কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই। ১৫০ মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। শওকত মিয়া সকলের খাওয়া ও থাকার বন্দোবস্ত করত। সে ছাড়া ঢাকা শহরে কেইবা করবে? আর একজন ঢাকার পুরানা লীগকর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান সহযোগিতা করছিলেন। ইয়ার মোহাম্মদ খানের অর্থবল ও জনবল দুইই ছিল। আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, “আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।”

“আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এদেশে একনায়কত্ব চলবে।”

সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল, ‘পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দি’। আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক সাহেব তাতে যোগদান করেছিলেন। একটা গঠনতন্ত্র সাব-কমিটি ও একটা কর্মপন্থা সাব-কমিটি করা হল। আমরা কাজ করা শুরু করলাম। শওকত মিয়া বিরাট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিল। টেবিল, চেয়ার সকল কিছুই বন্দোবস্ত করল।”

ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছরের স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহন করেন। শওকত আলী আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামীলীগের সাথে ছায়ার মত মিশে ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহন করে শওকত আলীর কাছে ঋনী বঙ্গবন্ধু যখন কৃতজ্ঞতাবশত জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কি চান শওকত ভাই?”
নিঃস্বার্থ, নির্লোভ দেশপ্রমিক শওকতের স্বভাবসিদ্ধ উত্তর ছিল, “মুজিব ভাই আছি তো আপনার সাথে। এর চেয়ে বেশি আর কি পাওয়ার আছে?” তিনি কোনদিন পদ কিংবা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেন নি।

শুধু ভাষা সৈনিক কিংবা আওয়ামীলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতায় নন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের ও অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক এবং মানবতাবাদী নেতা। মানুষের দুঃখ, কষ্ট এবং বিপদে-আপদে সবসময় তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসেবক এবং দানবীর। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে (তেতাল্লিশ এর মন্বন্তর) খাদ্য সংকটে মানুষ যখন দিশেহারা, লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন দূর্ভিক্ষে খাদ্যাভাবে মারা যান সেই সময় তরুণ শওকত আলী পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লায় লঙ্গরখানা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলে মানুষের চরম দুঃসময়ে তাদের পাশে থেকেছেন, মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। একসময় পুরান ঢাকার অধিবাসীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেন “দুর্ভিক্ষ শওকত”। পুরান ঢাকার বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক মানুষ এখনো তাকে “দুর্ভিক্ষ শওকত” নামেই বেশী চিনেন।

শওকত আলী, ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট রেডিওতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার খবর শুনে প্রচন্ড মানসিক কষ্ট পান। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়া শওকত আলী কাঁদতে পারেননি। ১৫ ই আগস্ট সারাদিন এবং রাতেও কোন খাবার খান নি। ১৬ ই আগস্ট ভোরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং কোমায় চলে যান। ১৭ ই আগস্টের মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৮ ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মারা যান। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী কারফিউ এর মধ্যে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজনের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তার জানাযা সম্পন্ন হয় এবং ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয় ইতিহাসের এই নায়ককে।

প্রতিবছর ২০ এপ্রিল এবং ১৮ ই আগস্ট আসে যায়, শওকত আলীর কথা কেউ মনেও করে না। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ কিংবা ২৩ শে জুন আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কয়জন উচ্চারণ করে তার নাম! শওকত আলী আজ বেঁচে নেই। নেই ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার, ছাত্রলীগ এবং আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার স্মৃতিবিজড়িত তার ১৫০ মোগলটুলির সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী অবৈধ শাসকের চক্রান্তে অদৃশ্য শক্তির ষড়যন্ত্রের কারনে ১৫০ মোগলটুলির সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি ছাড়তে হয়েছিল পরিবারের সদস্যদের। তবে আছে এই বাড়িতেই জন্ম নেওয়া শওকত আলীর আদর্শিক রক্তের উত্তরসুরীরা। যারা তার অবিনাশী চেতনা ধারন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি অন্তরে লালন করেন পিতার মতই পদপদবি হীন হয়ে।

এই অবস্থার অবসান হোক! আদর্শিক রক্তের ত্যাগী উত্তরসুরীরা ফিরে আসুক রাজনীতির মঞ্চে। উচ্চারিত হোক শওকত আলীদের নাম, স্মরণ করুক বিনম্র শ্রদ্ধায়। ২০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও বন্ধু ভাষা সৈনিক শওকত আলীর ১০৪ তম জন্মবার্ষিকীতে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক- মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট ও তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা, খুলনা।

আপনার মতামত লিখুন :