মেহেরপুরে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুপিবাতি

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  08:07 AM, 08 June 2021

আধুনিক বৈদ্যুতিক যুগে বর্তমানে আবহমান গ্রাম বাংলার এক সময়ের কুপিবাতি এখন শুধুই স্মৃতি। মাত্র ১৫/২০ বছর আগেও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে অতি প্রয়োজনীয় কুপিবাতি আজ বিলুপ্তির পথে।

সন্ধ্যা হলেই মেহেরপুরের জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও গ্রাম্য বাজারে কুপির মিটমিট আলোয় চেনা যেত হাট-বাজারসহ গ্রামের সেই চিরচেনা রুপ। আগের দিনের মানুষের ছিল নানা ধরনের বাহারি কুপি। সেই কুপই ছিল মানুষের অন্ধকার নিবারণের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু কালের আবর্তে আধুনিক বৈদ্যুতিক যুগে বর্তমানে সেই কুপিবাতির স্থান দখল করে নিয়েছে বাহারী বৈদ্যুতিক বাল্ব, চার্জার লাইট, র্টচ লাইট, মোবাইল লাইটসহ আরো অনকে কিছু। ফলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় এই নিদর্শনটি।

তৎকালিন সময়ে মানুষ মাটি, বাঁশ, লোহা, কাঁচ আবার কোনটি তৈরী করতো পিতল দিয়ে। সার্মথ্য অনুযায়ী লোকজন কুপি কিনে সেগুলো ব্যবহার করত। গাংনীর বাজার সহ সাধারণত উপজেলার ছোট বড় বাজারের দোকানে বিভিন্ন ধরনের কুপি পাওয়া যেত। কুপি হতে বেশি আলো পাওয়ার জন্য ছোট কুপি গুলোর জন্য কাঠ, মাটি বা কাঁচের তৈরি গজা বা স্ট্যান্ড ব্যবহার করা হতো। এই গজা বা স্ট্যান্ডগুলো ছিল বিভিন্ন ডিজাইনের। কিন্তু বর্তমানে গ্রামে গ্রামে বৈদ্যুতের ছোঁয়ায় সেই কুপিবাতি হারিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও অবশিষ্ট সময় মানুষ বর্তমানে ব্যবহার করছে বিভিন্ন ধরনের চার্জার লাইট ও মোমবাতি।

গাংনী উপজেলার মহাম্মদপুর গ্রামের কুপিবাতি তৈরীর কারিগর শ্রী লক্ষণ দাস এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গাংনীর চোখ’কে জানান, কুপিবাতি তৈরি করে আমরা উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ও দোকানে বিক্রি করতাম।আমরা কাচের বেতল,মাটি,টিন,পিতল,লোহার কুপিবাতি তৈরি করতাম। মানুষ তার সামর্থের মধ্যে দিয়ে এই কুপিবাতি ক্রয় করে সেখানে পাট ও কাপড়ের ফিতা তৈরি করে কেরোসিন ও ডিজেল তেল ব্যবহার করে এই কুপিবাতিতে আগুন জ্বালিয়ে মানুষটার রাতের অন্ধকার নিবারণ করত। আজ এই কুপিবাতি বিক্রি নেই কালের পরিবর্তনে কুপিবাতি বিক্রেতারা অসহায় ও মানবতার জীবনযাপন করছে। তিনি আরো জানান আজ প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ,সৌর বিদ্যুৎ এর সংযোগ লেগেছে। যদি কখনো বিদ্যুতের বিঘ্ন ঘটে তাহলে বৈদ্যুতিক চার্জার লাইটসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ তারা ব্যবহার করছে কিন্তু কুপিবাতির ব্যবহার আজ আর গ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় না বললেই চলে।

এ বিষয়ে গাংনী বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মাসুদ রানার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গাংনীর চোখ’কে জানান, এক সময় আমরা কুপিবাতি ব্যবহার করে মাছ বিক্রি করতাম। কালের বিবর্তনে আজ আমাদের এখানে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ সংযোগের গোলযোগ হলেও আমরা কুপিবাতি ব্যবহার না করে মোমবাতি দিয়ে সামরিক দুর্ভোগ মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে থাকি।

এ বিষয়ে আর,বি,জি,এম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান লিখনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গাংনীর চোখ’কে জানান, আমরা যখন লেখাপড়া করেছি তখন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। কুপিবাতিতে লেখাপড়া করতাম,পাশাপাশি গ্রীষ্মকাল আসলে একটি ফাঁকা জায়গায় কুপি বাতি জ্বালিয়ে বন্ধু-বান্ধবসহ পরিবারের লোকজনের সাথে খোশগল্প আমরা মেতে উঠতাম। আজ আমার বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-ছাত্রীরাই কুপিবাতি চেনেন না। বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে আজ কুপিবাতির কেবল বিলুপ্তির পথে।

এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা(অবঃ) ইঞ্জিনিয়ার হাবিলদার মোঃআতাউল হক এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি গাংনীর চোখ’কে জানান, আমি ১৯৩৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী(বর্তমান বাংলাদেশ) যোগদান করি তখন কুপিবাতি ব্যবহার করে আমরা আমাদের সকল দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করতাম। আমরা দেখতাম পরিবারের লোকজন ডাক হরকরার মাধ্যমে চিঠি পাঠাতো,সেই চিঠি কুপিবাতি জ্বালিয়ে ডাক হরকরা পৌঁছে দিত।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাবেক সেনাপ্রধান মোস্তাফিজুর রহমান স্যারের সাথে এই কুপিবাতি জ্বালিয়ে খাওয়া-দাওয়াসহ বিভিন্ন পরামর্শ ও সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। আজকে কালের বিবর্তনে সেই কুপিবাতি এখন বিলুপ্তির পথে। তিনি আরো বলেন, এই কুপিবাতি সম্পর্কে নাতি-নাতনিদের কাছে গল্প বলে তাদের আগ্রহ জাগে যে সেটি আবার কি জিনিস আর কিভাবে আলো জ্বলে।

এবিষয়ে মেহেরপুর রিপোর্টার্স প্রেসক্লাবের সভাপতি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন এর জেলা প্রতিনিধি মাহাবুবুল হক পোলেন’র কাছে জানতে চাইলে তিনি গাংনীর চোখ’কে বলেন, আধুনিক বৈদ্যুতিক যুগে বর্তমানে কুপিবাতির স্থান দখল করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক বাল্ব, চার্জার লাইট, টর্চ লাইট, মোবাইল লাইটসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক বাহারী যন্ত্র। ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় এই নিদর্শনটি। আগের দিনে কুপিবাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা, পুথি পাঠ, কেচ্ছা কাহিনির নানা গল্প হতো। তবে সময়ের পরিবর্তনে এসব আর চোখে পড়ে না। ফলে এমন সময় আসবে যখন ভবিষৎ প্রজন্মদের কুপিবাতি চেনানোর জন্য জাদু ঘরে নিয়ে যেতে হবে। তিনি আরোও বলেন, গ্রামের অধিকাংশ লোকের কাছে কুপরি কদর হারিয়ে গেলেও এখনও অনেক লোক আছে যারা আঁকড়ে ধরে আছেন কুপরি সেই স্মৃতি। গ্রামের সৌখিন গৃহস্ত বাড়ি ও অনেকে নিম্ন আয়ের মানুষ স্বযত্নে কুপিবাতি সংরক্ষন করে রেখেছেন নিদর্শন হিসেবে।

উল্লেখ্য,এই কুপিবাতিকে গ্রাম গঞ্জের লোকজন লম্পো নামে বেশি চেনেন।

আপনার মতামত লিখুন :