মেহেরপুরে ৪৬৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  06:03 PM, 18 February 2022

অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি আমাদের অহংকারের এবং গর্বের। এই গর্বের বহিঃপ্রকাশ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানোর মধ্য দিয়ে। কিন্তু ভাষার জন্য প্রান দিয়ে গত ৭০ বছরেও সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এখনো খুঁজে ফিরতে হয় শহীদ মিনার। দেশে প্রতিটি আন্দোলনের পিছনে থাকে ছাত্র সমাজ। সেই ছাত্র সমাজকে সেইসব আন্দোলনের ইতিহাস ও শদ্ধা জানাতেই নির্মিত হয় শহীদ মিনার। কিন্তু দুঃখের বিষয় মেহেরপুর জেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। যেগুলি আছে সেগুলি ফেব্রয়ারি মাস আসলে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। ফেব্রয়ারি মাস শেষ হলেই শহীদ মিনারের চত্ত্বরে হয় গরু ছাগলের আলসেখানা।
মেহেরপুর জেলায় অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজো গড়ে ওঠেনি শহীদ মিনার। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে তার ভিতর বেশির ভাগই রয়েছে অযতœ অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ফুল দিয়ে শহীদদের সম্মান জানাতে পারে না। অনেক প্রতিষ্ঠানে শুধু জাতীয় পতাকা তুলেই দায়িত্ব পালন করেন শিকক্ষকেরা।
সরোজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিভিন্ন মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪৩ টি, মাদ্রাসার মধ্যে ৪টি এবং কলেজের মধ্যে ৬ টিতে শহীদ মিনার আছে। বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন শহীদ মিনার নেই। তবে এবছর বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মামানাধীনের কাজ চলছে। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনারের নির্মান কাজ শেষেরপথে। সেইসব প্রতিষ্ঠান এবার ২১শে ফেব্রয়ারিতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পারবে।
যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে সেগুলো রয়েছে অযত্ন অবহেলায়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একুশে ফেব্রুয়ারির দিন বন্ধ থাকে। কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনারে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মাঝে মধ্যে ফুল দিয়ে থাকে। এখানে ভাষা আন্দোলন বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কোনো আলোচনা সভাও হয় না। শুধু মাত্র পতাকা উত্তোলন করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সম্পর্কে তেমন কিছুই শিখতে বা জানতে পারছে না।

অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাত ফেরী ও শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া করা হয়। শহীদ মিনার না থাকায় ফুল দিয়ে সম্মান জানাতে পারেনা শিক্ষার্থীরা।
জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যানুযায়ী জেলায় মোট ৫১৮ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় ৩টি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১৪টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১১টি, সরকারি কলেজ ৪টি, বেসরকারি কলেজ ১২টি, কারীগরী শিক্ষা কেন্দ্র ৬টি, কলেজিয়েট স্কুল ৫টি, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৯৬টি, নন-রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭টি এবং মাদ্রাসা ৬০টি। বিভিন্ন মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪৩ টি, মাদ্রাসার মধ্যে ৪টি এবং কলেজের মধ্যে ৬ টিতে শহীদ মিনার আছে। বাকি ৪৬৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন শহীদ মিনার নেই। তবে এবছর বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মামানাধীনের কাজ চলছে। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনারের নির্মান কাজ শেষেরপথে। সেইসব প্রতিষ্ঠান এবার ২১শে ফেব্রয়ারিতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পারবে।
কয়েকজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানান, সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শহীদ মিনার নির্মাণ করার ইচ্ছে থাকলেও তা করা সম্ভব হয়ে উঠছেনা। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করার নিজস্ব ফান্ড পর্যাপ্ত না। যদি সরকারীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় তবে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতভাগ শহীদ মিনার নির্মিত হবে।
শিক্ষার্থীরা জানায়,৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযোদ্ধার সঠিক ইতিহাস আগামী প্রজন্মদের মাঝে তুলে ধরতে হলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনার স্থাপন করা একান্ত দরকার শিক্ষার্থরা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃত। আমরা জানি শুধু দেশেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শহীদ মিনার আছে। অথচ আমাদের বিদ্যালয়ে কোন শহীদ মিনার না থাকায় আমাদের খুব কষ্ট হয়।

শিক্ষার্থীর অভিভাবক শরিফুল ইসলাম জানান, অজ্ঞতাই হোক আর যে কারনেই হোক মেহেরপুরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের শহীদদের তাৎপর্য জানাতে, শেখাতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরী করা জরুরী।
মুজিবনগর সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাজাহান আলী বলেন,আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদদের সম্মান জানানোর জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা উচিৎ। সরকারী বারাদ্দ না থাকায় শহীদ মিনার নির্মান করা সম্ভব হয়না। আমরা চেষ্ঠা করছি আমাদের স্কুলে যে শহীদ মিনারটি রয়েছে এবছরে কাজ সর্ম্পূন করবো।
বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য কবি ও গবেষক এবং মেহেরপুর সরকারী মহিলা কালেজ অধ্যাপক (অব.) ড. গাজী রহমান বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য যে স্রোতধারায় আমরা আজ অবজ্ঞান করেছি সেটা আজ ভুলোকৃতের পথে।রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে-মেয়েদের ভাষা শহীদদের প্রতি গুরুত্ব এবং ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রতিদিন স্কুল-কলেজে শহীদ মিনার থাকা উচিত। সেই সাথে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য পূর্ণ ব্যাখ্যা শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।
মেহেরপুর নির্বাহী প্রকৌশলী (শিক্ষা) গোলাম মোত্তাকিন বলেন, ইতেমধ্যে প্রতিটি স্কুল প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপনের ব্যাপারে উদ্দোগ গ্রহন করা হয়েছে। অতি শিগ্রই তা বাস্তবায়ন হবে। আমাদের পক্ষ হতে উপর মহলে আবেদন করা হয়েছে যাতে সকল স্কুল কলেজে একটি করে শহীদ মিনার যেন হয়।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মাহাফুজুল হোসেন উজ্জল বলেন, সরকারী উদ্যোগে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপন করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিৎ। মেহেরপুরে ১৭৪ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে তো নেই। আশা রাখি আগামীতে ভাষা আন্দোলনের শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেননের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার তৈরীর করা উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খাঁন জানান, সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবার শহীদ মিনার নির্মাণ করছে। বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে যাতে এবছর না হলেও আগামী বছর যেনো প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মান করা হয়।

আপনার মতামত লিখুন :