মশা মারা শিখতে বিদেশ ভ্রমণ, ব্যয় ১০ কোটি

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  08:48 AM, 11 September 2023

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু এবার ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। মাসের হিসাব গরমিল করে দাপট দেখাচ্ছে লম্বা সময় ধরে। মৃত্যু-আক্রান্তের সব রেকর্ড এরই মধ্যে ভেঙেছে। এ সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এমনটা হচ্ছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। তাই মশাবাহিত রোগ ও বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াসহ চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতির জন্য একটি প্রকল্প নিচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি)।

বিশ্বব্যাংক এরই মধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করেছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে রক্ষায় বৈদেশিক গবেষণা বাবদ ১০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর পলিসি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে গবেষণা করতে বিদেশে যাবেন ৬০ কর্মকর্তা। এজন্য অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চায়না, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা ব্রাজিলকে বেছে নেওয়া হতে পারে। মূলত ভেক্টর ম্যানেজমেন্টে এসব দেশ সফল হয়েছে। প্রকল্পে ২০টি পাবলিক টয়লেট খাতে খরচ ধরা হয়েছে ৫৮ কোটি টাকা। আর একটি ফগার মেশিন কিনতে ব্যয় সংস্থান করা হয়েছে ৫ লাখ টাকা অথচ বাজারে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় ভালো মানের ফগার মেশিন পাওয়া যায়।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি) এ সম্পর্কিত ‘ইম্প্রুভমেন্ট অব আরবান পাবলিক হেলথ প্রিভেন্টিভ সার্ভিসেস’ নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির সভায় (পিইসি) পরিকল্পনা কমিশন এলজিইডির প্রস্তাবের বেশকিছু বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এছাড়া নানা খাতের ব্যয় নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘খুব যৌক্তিক না হলে কোনো বিষয় আমরা অনুমোদন দেবো না। ৬০ জন কর্মকর্তার বৈদেশিক গবেষণার বিষয়টি এখনো ফাইনাল কিছু হয়নি। যদি দেখি এটা দরকার নেই তবে বাদ যাবে।’

পিইসি সভায় সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের এক প্রতিনিধি বলেন, এক হাজার ২৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্পে মাত্র ৪৪৭ কোটি টাকার ক্রয় পরিকল্পনা উল্লেখ করা হয়েছে। বাকি ৮৪১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ক্রয় পরিকল্পনাবহির্ভূত। ক্রয় পরিকল্পনাবহির্ভূত আইটেমগুলোর ব্যাখ্যা পুনর্গঠিত প্রকল্পে থাকা যৌক্তিক হবে।

একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণে প্রায় তিন কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি) মশা নিয়ন্ত্রণের এ প্রকল্পে। শুধু পাবলিক টয়লেটই নয়, এমন নানা ব্যয়প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। জনবহুল জায়গায় ওয়াটার পয়েন্ট স্থাপন, মশা মারার ফগার মেশিন কেনা বা ময়লা সরানোর ট্রলি কেনাসহ প্রকল্পটির অধিকাংশই কেনাকাটা বেজড। এক হাজার ২৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্পে এক হাজার ৭৩ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, বাকি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবিত প্রকল্পটিতে দেখা যায়, ২০টি মোবাইল টয়লেট বা পাবলিক টয়লেট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, একেকটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণে খরচ হবে দুই কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অথচ দেশের সবচেয়ে বেশি টয়লেট নির্মাণ করা স্থানীয় সরকার বিভাগেরই আরেক প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) ২০ থেকে ২২ লাখ টাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করছে। ঢাকা শহরে সেই পাবলিক টয়লেট নির্মাণে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রকৌশলী ও উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন।

প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি করা হয়েছিল। যার সভাপতি স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর এপিএস নুরে আলম সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, ‘প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি ঠিক নয়। মূলত ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে রিসার্চ করার খাতে টাকা রাখা হয়েছে। যে সব দেশ ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফল হয়েছে সেসব দেশে রিসার্চ করতে যাবেন কর্মকর্তারা। আগে দুই মাস ডেঙ্গু থাকতো, কিন্তু এখন সারা বছর দেখা যাচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জ হচ্ছে। এই সময়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। এ বিষয়ে রিসার্চ করা হবে। অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফলতা দেখিয়েছে। আমাদের এ বিষয়ে গবেষণা দরকার ও বিশেষজ্ঞ তৈরি জরুরি। এজন্য রিসার্চ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ডেঙ্গুর পূর্বাভাস নেই। এটা আমাদের দরকার। এটা নিয়ে রিসার্চ দরকার।’
প্রকল্পটির প্রস্তাবনা অনুযায়ী, শহরের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে নির্মাণ করা হবে ওয়াটার পয়েন্ট। যেখান থেকে জনগণ হাত ধোয়া ও পানি খেতে পারবে। একেকটি ওয়াটার পয়েন্ট নির্মাণে খরচ পড়ছে এক কোটি টাকা।

এক ফগার মেশিন ৫ লাখ, ময়লা ফেলার ট্রলি সাড়ে ৭ লাখ

প্রকল্পটিতে মশা মারার ধোঁয়া ছাড়ার ১০০টি ফগার মেশিন কিনতে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, একেকটি ফগার মেশিনের দাম পড়ছে পাঁচ লাখ টাকা। অথচ বাজারে ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে এসব ফগার মেশিন পাওয়া যাচ্ছে। প্রকল্পটিতে বিভিন্ন স্থান থেকে ময়লা সরানোর জন্য ৪০টি হুইল ব্যারো বা ময়লা স্থানান্তরের ট্রলি কিনতে খরচ ধরা হয়েছে তিন কোটি টাকা। অর্থাৎ, একটি ট্রলি কিনতে খরচ পড়ছে সাড়ে সাত লাখ টাকা। অথচ এসব ট্রলি অন্য প্রকল্পে মাত্র ২০ হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্পটিতে অন্য কেনাকাটায়ও এমন অধিকাংশ পণ্য মূল দামের চেয়ে ৫ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

৩ গাড়িতে ব্যয় ৭ কোটি

এলজিইডির প্রকল্প প্রস্তাবে রয়েছে নানা অসঙ্গতি। সরকারের নিষেধাজ্ঞার পরও প্রকল্পে বিলাসবহুল গাড়ি কেনা ও বিদেশ সফরের কথা বলা হয়েছে। যদিও চট্টগ্রাম বাদে বাকি এলাকা ঢাকার আশপাশেই। সরকারি অর্থে প্রতিটিতে কোটি টাকার বেশি খরচ করে তিনটি জিপ কেনার জন্য ধরা হয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। সেগুলোর পেছনে খরচ ধরা হয়েছে আরও সাড়ে তিন কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গাড়ির জন্য ব্যয় হবে সাত কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সবশেষ সার্কুলার অনুযায়ী যানবাহন কেনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রকল্প ঋণের আওতায় যেহেতু যানবাহন কেনা বাদ দিতে হবে, প্রয়োজনে কিছু গাড়ি ভাড়া নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া এখন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রকল্পে বিদেশ সফরও নিষেধ রয়েছে। এটাও বাদ দেওয়া যেতে পারে।

এদিকে জিওবির আওতায় বিভিন্ন বিষয়ের মেরামত খাতে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আসবাবপত্রে দুই কোটি, কম্পিউটারে দুই কোটি, অফিস সরঞ্জামে দেড় কোটি, মেশিনারি-ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জামে দুই কোটি এবং সাজসজ্জায় পাঁচ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অনেক বেশি বলে মনে করছে কমিশন। এজন্য এসব খাতে ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর কথা বলা হয়েছে।

প্রকল্প ঋণের আওতায় পরিচালন ব্যয়ের পেছনেই প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ বা ১৭৯ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ব্যয় অনেক বেশি মন্তব্য করে ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর কথাও বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

তিন অফিসারের বেতন-ভাতা ৩ কোটি ৪০ লাখ

প্রকল্পে তিনজন অফিসারের জন্য বেতন-ভাতায় খরচ হবে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা। তারপরেও চার লাখ টাকা অবসর ভাতা, বিশ্রাম ভাতা পাঁচ লাখ টাকা, বিনোদন ভাতা চার লাখ টাকা, মোবাইল ভাতা চার লাখ টাকা, আবাসিক ফোন ভাতা চাওয়া হয়েছে ছয় লাখ টাকা। সবই ব্যয় করা হবে সরকারি অর্থ থেকে। টিভি, রেডিও পত্রিকায় প্রচার ও প্রচারণা খাতে ব্যয় হবে ৭২ কোটি টাকা।

প্রকল্প ঋণের আওতায় আউটসোর্সিং সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে ২৬৬ জনের জন্য ৬০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাজের ধরন দেওয়া হয়নি।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বিদেশে প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রকল্প ঋণের অর্থায়নে স্থানীয় প্রশিক্ষণ বাবদ ৯৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে কোন বিষয়ে কতজনকে, কাদের কোন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তা জানানো হয়নি।

দেশে মশা নির্মূল ও স্বাস্থ্যখাতের কাজ বছরের পর বছর ধরে চলে এলেও প্রকল্প ঋণের অর্থায়নে ১৩ জন পরামর্শকের পেছনে ৩৯ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এত পরামর্শক ও তাদের পেছনে ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে।

কমিশন বলেছে, এ প্রকল্পে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জনবলের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে বৈদেশিক অর্থায়নের নিশ্চয়তাও পাওয়া যায়নি। আগে অর্থায়ন ঠিক করতে হবে।

জানা যায়, মশা মারার পাশাপাশি মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অসংক্রামক রোগ বিষয়েও কার্যক্রম থাকবে এ প্রকল্পে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সাভার পৌরসভা ও নারায়ণগঞ্জের তারাবো পৌরসভায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৮ মেয়াদে পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

সূত্রঃ জাগো বিডি।

আপনার মতামত লিখুন :