প্রশংসায় ভাসছেন মুসকান :: মাওলানা মাহমুদ আসআদ মাদানির ৫ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  03:47 PM, 10 February 2022

একদল যুবকের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের সামনে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি উচ্চারিত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন বোরকা পরা এক কলেজ ছাত্রী। গেরুয়া উত্তরীয় পরা একদল যুবকের সামনে বোরকা-হিজাব পরে একাই প্রতিবাদ জানিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকের ওই কলেজ ছাত্রী। তার এ সাহসীকতার কারণে সারা বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। তার সাহসী ভূমিকার জন্য মুসকান খান নামের ওই ছাত্রীকে পাঁচ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) এ পুরস্কার ঘোষণা করে ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। টুইট বার্তায় জমিয়তের সভাপতি মাওলানা মাহমুদ আসআদ মাদানির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়।

গেরুয়া রুমালধারী শত শত ছেলে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলে যেন নেকড়ের পালের মতো হামলে পড়েছিল একলা এক ছাত্রীর উপর। প্রথমে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও পরে সিংহীর মতো রুখে দাঁড়ান বোরকাপরা ওই ছাত্রী। তার একার ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান ছাপিয়ে যায় শত কন্ঠের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিকে। ওই ছাত্রী বুঝিয়ে দেন, একা হলেও ইসলামী শক্তিতে বলীয়ান তিনি। তার সাহসিকতার এ ভিডিও তোলপাড় তুলেছে সামজিক মাধ্যমগুলোতে। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, নোবেলজয়ী মালালার মতো অনেকেই সমর্থন জানিয়েছেন ওই ছাত্রীকে।

২০১৪ সালে কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন মুসলিমরা। এবার বিজেপি জোয়ার তুলেছে হিজাব নিষিদ্ধকরণের। সম্প্রতি কর্ণাটকের স্কুলগুলোতে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যার জেরে প্রতিনিয়ত হিজাবধারী নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এর সর্বশেষ শিকার হয়েছেন মুসকান খান নামের ওই ছাত্রী। মঙ্গলবার ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হিজাব পরা মুসকানকে তার বাইকে কর্ণাটকের পিইএস কলেজে গিয়ে নামতে দেখা যায়। তারপর গেরুয়া স্কার্ফ পরা একদল ছেলে তাকে উদ্দেশ করে কটূক্তি করে। কলেজ প্রশাসন মেয়েটিকে দল থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, কারণ তারা তার দিকে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানে দেয় ও গালি ছুঁড়তে থাকে। মুসকান প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পরে একাই প্রতিবাদ জানায়। শত শত ছেলের বিরুদ্ধে একা একটি মেয়ে হয়েও সে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে প্রতিবাদ জানায়। তার স্লোগানে ছাপিয়ে যায় শত কন্ঠের ‘জয় শ্রীরাম’ চিৎকারকেও।

টুইট বার্তায় বলা হয়, নিজের আইনি ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় তীব্র বাধার মুখেও একাই পুরো দলের প্রতিবাদ করায় সাহসী ছাত্রী মুসকান খান বিনতে মুহাম্মদ হুসাইন খানের প্রতি শুভেচ্ছা। জমিয়তের পক্ষ থেকে এই সাহসী তরুণীর জন্য পাঁচ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, কলেজে হিজাব পরা নিয়ে চরম বিতর্ক চলছে কর্ণাটকে। গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবক ও হিজাব পরা শিক্ষার্থীদের চরম উত্তেজনার মধ্যেই রাজ্যের সব স্কুল-কলেজ তিন দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

রাজ্যজুড়ে চলা উত্তেজনার মধ্যে বোরকা-হিজাব পরে কলেজ ক্যাম্পাসে এসে হয়রানির শিকার হয়েছেন মুসকান খান। এ সময় তিনি একাই প্রতিবাদ করেছেন। একদল যুবকের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের সামনে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে অবিচল থেকেছেন ওই ছাত্রী। এ ঘটনার ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।

এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসকান খান কর্ণাটকে মান্ডি এলাকার একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বাণিজ্যিক বিভাগের ছাত্রী।

ভিডিওতে দেখা যায়, বোরকা-হিজাব পরে বাইক চালিয়ে কলেজে আসেন মুসকান। তখন গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবকেরা তার দিকে তেড়ে আসেন এবং ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেন। এ সময় মুসকান সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সামনে হেঁটে আসেন। পেছনে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে যুবকদের আসতে দেখে মুসকান ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেন। সেখানে মুসকানকে বাঁচাতে দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।

মুসকান এনডিটিভিকে বলেন, ওই যুবকদের বেশির ভাগ বহিরাগত। তারা কলেজের শান্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। হিজাব নিয়ে কলেজের হিন্দু বন্ধুরা কিছু না বললেও বহিরাগত যুবকরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন।

ওই সময়কার বর্ণনা দিয়ে মুসকান বলেন, আমি ভয় পাইনি। কলেজে ঢোকার সময় আমি বোরকা পরা দেখে তারা আমাকে ঢুকতে দিতে চাইছিল না। তারা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে থাকলে আমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে শুরু করি। কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রভাষকেরা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন এবং আমাকে সুরক্ষা দিয়েছেন।

গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবককের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কাছে শিক্ষার প্রাধান্য সবার আগে। কিন্তু তারা আমাদের শিক্ষা ধ্বংস করে দিতে চাইছে। আমরা হিজাব ও বোরকা পরে বহুদিন ধরেই কলেজে আসছি। কিন্তু হিজাব বিতর্ক গত সপ্তাহে শুরু হয়েছে।

এই কলেজছাত্রী বলেন, হিজাব আমাদের একটি অংশ। মুসলিম মেয়ে হিসেবে এটা আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা হিজাব রক্ষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব।

প্রসঙ্গ, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উদুপির গভর্নমেন্ট গার্লস পিইউ কলেজে ছয় ছাত্রীকে মাথায় হিজাব পরে আসায় ক্লাসে ঢুকতে দেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ওই দিন থেকে আন্দোলন শুরু হয়, ক্রমে তা রাজ্যের অন্য স্কুল-কলেজগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে উদুপি ও চিক্কামাগালুরে ডানপন্থী সংগঠনগুলো ছাত্রীদের হিজাব পরে কলেজে প্রবেশের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিবাদ জানাতে থাকে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে কলেজে সংঘর্ষও হয়।

হিজাব ইস্যুতে রাজ্যের বহু স্কুল-কলেজে বিক্ষোভ এখনও অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কর্ণাটক হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছে।

মঙ্গলবার এ মামলার শুনানি চলে। বুধবারও (৯ ফেব্রুয়ারি) শুনানির নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
হিজাব পরে ক্লাসে প্রবেশের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানি নারী শিক্ষা অধিকারকর্মী ও শান্তিতে নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই। তিনি এ ঘটনাকে ‘ভয়ঙ্কর’ একটি পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন। এক টুইট বার্তায় মালালা ইউসুফজাই বলেন, ‘কলেজগুলো আমাদের হিজাব বা পড়ালেখার মধ্যে যে কোনো একটিকে বাছাই করতে বলছে। হিজাব পরে মেয়েদের স্কুলে যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত একটি ভয়ঙ্কর ভুল পদক্ষেপ। নারীদের হিজাব পরা নিয়ে কম বেশি আপত্তি থাকেই। তবে ভারতের নেতাদের উচিত মুসলমান নারীদের প্রান্তিককরণ বন্ধ করা’।

এদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে বিতর্ক কর্ণাটকের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় গোটা ভারতেই। রাজধানী দিল্লি ও কলকাতাতেও এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ বিক্ষোভ করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভের আয়োজন করে দ্য মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি ছাত্র সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে আয়োজিত ওই বিক্ষোভে বহু শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীও ছিলেন এবং হিজাব পরেই তারা সেখানে বিক্ষোভ করেন। এসময় কর্ণাটকের আন্দোলনকারীদের সমর্থনে তারা বিভিন্ন ব্যানার বহন করেন। ব্যানারে লেখা ছিল – ‘আমরা, মোহাম্মদ (সাঃ) এর অনুসারী। আমরা ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই করবো’ এবং ‘কর্ণাটকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি।’

দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের পদুচেরিতেও এর ছোঁয়া লেগেছে। মধ্যপ্রদেশের এক মন্ত্রী ইতোমধ্যে কলেজ ও স্কুলের ‘ইউনিফর্ম ড্রেস কোডের‘ বিষয়ে জোর দিয়েছেন। এছাড়া পদুচেরিতে একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে না দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কসার্কাস ক্যাম্পাসে হিজাবের পক্ষে সমর্থন জানান ছাত্রছাত্রীরা। বিশাল পোস্টার, ব্যানার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল দেখা গেল। বার্তা একটাই- ‘হিজাব আমার সাংবিধানিক অধিকার’। তাদের পোস্টারে আরো লেখা, ‘রক্ত চাই রক্ত নাও, আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দাও’। বিক্ষোভকারী প্রত্যেক ছাত্রীই হিজাব পরিহিতা। ছাত্রীদের সঙ্গে এই দাবিতে শামিল ছাত্ররাও।

মুসলিম ছাত্রীদের ক্লাসরুমে হিজাব পরা নিয়ে আপত্তিতে বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে তুমুল বিতর্ক উসকে উঠেছে দিনকয়েক আগেই। এ বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। কয়েকটি কলেজ হিজাব পরে ছাত্রীদের কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে বটে, তবে ছাত্রীরা ওই পোশাক পরে ক্লাস করতে পারবেন কিনা, তা স্পষ্ট করা হয়নি। এদিকে মুসলিম ছাত্রীদের দাবি, তাদের হিজাব পরেই ক্লাস করার অনুমতি দিতে হবে। এসবের মাঝেই কলেজগুলোতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদী ছাত্র সংগঠনগুলোও। তাদের পালটা দাবি, হিজাব পরে ক্লাস করা যাবে না। এর পালটায় তারাও গেরুয়া উত্তরীয় পরে প্রতিবাদ শুরু করে। হিজাব ইস্যুতে পক্ষ-বিপক্ষ নানা মত তৈরি হয়েছে। রাজনীতিবিদরাও একযোগে নেমেছেন সমর্থন বা বিরোধিতায়।

আপনার মতামত লিখুন :