সাংবাদিকতা আসলেই কি নিরাপদ?
দেশের পেশাদার সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন বিএফইউজে—বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছি বর্তমানে। অভাব, অভিযোগ আর পেশাগত সমস্যা নিয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সহকর্মীরা ফোন করেন। কোনোটা সমাধান হয়, কোনোটা হয় না।
অভাব, অভিযোগ শুনলে কষ্ট লাগে। ভাবি, সমস্যা আজ আছে, কাল আশাকরি সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার—এমন ঘটনার সমাধান কোথায়? মাসে অন্তত ২/৩টা খবর আসে, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সেই ঘটনার সামনে পেছনে সমাজের দায়িত্বশীল মানুষদের হাত দেখা যায়।
২৮ আগস্ট ২০২৩, বরিশালে শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে দুই ছাত্রী র্যাগিংয়ের শিকার হন। ছাত্রী হলের ৬০৬ নম্বর কক্ষে রাতভর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। একাডেমিক কাউন্সিলে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীদের বক্তব্য গ্রহণের সময় সংবাদ সংগ্রহে যান সাংবাদিকেরা। ছাত্রীদের বক্তব্য নেওয়ার সময় কয়েকজন শিক্ষক হামলা করেন সাংবাদিকদের ওপর। এই সময় টেলিভিশনের ক্যামেরাও ভাঙচুর করেন তারা।
শিক্ষক হামলা করেছেন পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের ওপর! শিরোনামটি যতবার পড়ি ততবার বিস্মিত হই। স্কুল ছেড়েছি ৩০ বছর হলো। এখনো শিক্ষকদের দেখলে শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে। পিতার মতো সম্মান করি তাদের।
সেই শিক্ষকসমাজের কয়েকজনের হাতে আমার সহকর্মী হামলার শিকার হলেন। শিক্ষকরা সাংবাদিকের ক্যামেরাও ভাঙচুর করলেন। ভিডিও ফুটেছে দেখেছি, তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। মুখের ভাষা শুনে তাজ্জব হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
কেন পেশাদার সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হলেন? হামলাকারী চিকিৎসক শিক্ষকদের সামনে পেলে এই প্রশ্নটিই করতাম। কী লুকাতে চেয়েছেন তারা?????
কেন পেশাদার সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হলেন? হামলাকারী চিকিৎসক শিক্ষকদের সামনে পেলে এই প্রশ্নটিই করতাম। কী লুকাতে চেয়েছেন তারা? র্যাগিংকে তারা সমর্থন করেন? নির্যাতিতদের মুখ বন্ধ রাখতে চান তারা? পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি সাংবাদিকেরা কোনো আইন ভঙ্গ করে থাকলে তার প্রতিকার কি তাদের ওপর হামলা, ক্যামেরা ভাঙচুর করা?
চিকিৎসক শিক্ষকরা সন্ত্রাসী ভূমিকায় যদি এভাবে মাঠে নামেন, তাহলে রোগীরা কি তাদের কাছ থেকে সুচিকিৎসা আশা করতে পারেন? কোড অব এথিকস কি তাকে সন্ত্রাসী হতে উৎসাহ দেয় নাকি একজন ভালো মানুষ হতে শিক্ষা দেয়?
পান থেকে চুন খসলে চিকিৎসকরা কর্ম বিরতিতে যান। চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত কেউ কর্মবিরতিতে যেতে পারেন কি? এটি কোড অব এথিকসের লঙ্ঘন। শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। ভর্তুকি দিয়ে চলে কলেজটি। জনগণের করের টাকায় দেশ কি সন্ত্রাসী তৈরি করছে?
সাংবাদিক সমাজ বেতন-ভাতা, চাকরির অনিশ্চয়তা, ছাঁটাই, গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। অনেক গণমাধ্যমে বেতন অনিয়মিত। ৯ম ওয়েজবোর্ড ঘোষণা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ বছর। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ছাড়া কোনো গণমাধ্যমে আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। বারবার বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে সাংবাদিকেরা না মালিক, না সরকার কারও কাছ থেকে কোনো সাড়া পায়নি।
১০ম ওয়েজবোর্ডেও দাবি নিয়ে সাংবাদিক সমাজ মাঠে নেমেছে। সরকারের তথ্যমন্ত্রীর কাছে সেই দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই আবেদনে ধুলা জমে যাচ্ছে, কিন্তু সরকার নীরব।
গণমাধ্যমকর্মী (চাকরি শর্তাবলি) আইন মাসের পর মাস জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটিতে পড়ে আছে। অংশীজনের মতামত নিয়ে পেশাদার সাংবাদিকদের রুটি-রুজি ও চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে আইনটি পাস করার দাবি এখন নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। পেশাদার সাংবাদিকদের একটি অংশ চাকরি হারা। আরেকটি অংশের বেতন ভাতা অনিয়মিত। ওয়েজবোর্ড বেতন পাচ্ছে না সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিকেরা।
সাংবাদিকেরা সবার কথা বলেন। সবার দুঃখ, বেদনা, পাওয়া না পাওয়ার গল্প সাংবাদিকই তুলে আনছেন। যার ফলে প্রতিকার পান অনেকেই….
সাংবাদিকদের ওপর হামলার সাথে এই বিষয়গুলো কেন টেনে আনলাম? সেই প্রশ্ন পাঠকের মনে জাগতে পারে। তাদের জন্য উত্তর হচ্ছে, এত সব সমস্যার ভেতরও সাংবাদিকতা পেশা অব্যাহত আছে। সমাজের সব পেশার, সব ধর্মের, সব শ্রেণির মানুষের কথা বলছে গণমাধ্যম। ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছেন সাংবাদিকেরা। সারাদিন টেলিভিশন, অনলাইন, পরের দিন সকালে ছাপা কাগজে সংবাদ পৌঁছে যায় সবার কাছে।
সাংবাদিকেরা সবার কথা বলেন। সবার দুঃখ, বেদনা, পাওয়া না পাওয়ার গল্প সাংবাদিকই তুলে আনছেন। যার ফলে প্রতিকার পান অনেকেই। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে যদি গণমাধ্যম না থাকে, সাংবাদিক না থাকেন, পরের দিন মানুষ হয়তো ঘর থেকে বের হতে নিরাপদ বোধ করবেন না।
গণমাধ্যম আছে বলেই মানুষ শেষ ঠিকানা হিসেবে সাংবাদিকের কাছে আসে। গণমাধ্যমের ওপর মানুষের এখনো ভরসা আছে। ভরসা আছে সাংবাদিকদের ওপরও। সেই জায়গায় যারা হামলা করে, যারা বন্ধ করতে চায় তাদের কী নামে ডাকা হবে তা পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
সব চিকিৎসক শিক্ষকদের বরিশালের ঘটনায় দায়ী করছি না। কিন্তু কয়েক বছরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো অনেক তরুণ চিকিৎসকরা পেশার সম্মান ক্ষুণ্ন করছেন। সন্ত্রাসীর ভূমিকায় তাদের হাজির হতে দেখে দানবের ছবি ভেসে ওঠে।
চিকিৎসক সমাজকে এই ছবি বদলাতে মাঠে নামতে হবে। গলদ খুঁজে বের করে তার ওষুধ দিতে হবে। তা না হলে ভালো সাংবাদিকতা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বরিশালের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া জরুরি। সন্ত্রাসী কেউ চিকিৎসক হতে পারেন না। মহান পেশাকে যারা কলুষিত করছেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করা চিকিৎসক সমাজের দায়িত্ব।
দীপ আজাদ ।। হেড অব নিউজ, নাগরিক টিভি।