সব ছিনিয়ে নববধূকে ধর্ষণ করে ৬ জন

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  09:51 AM, 04 December 2020

সেদিন সন্ধ্যায় কলেজ গেট থেকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে স্বামী-স্ত্রীকে গাড়িতে করে ছাত্রাবাসের নির্জন জায়গায় নিয়ে যায় ছাত্রলীগকর্মী সাইফুর ও তার সহযোগীরা। ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে ব্যর্থ হয়ে স্বর্ণালঙ্কার ও তরুণীর স্বামীর পকেটে থাকা নগদ ২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এর পর স্বামীকে আটকে রেখে সদ্য বিবাহিত তরুণীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে সাইফুরসহ ছয়জন। তাদের সহযোগিতা করে আরও দুজন। ধর্ষণে তরুণীর মুমূর্ষু অবস্থা হলে তাকে ছেড়ে দিয়ে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে এসে গাড়ি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য শাসিয়ে দেয়। সিলেটে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে লোমহর্ষক ধর্ষণকা-ের দুই মাস পর পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে এমন চিত্র। ধর্ষকদের ডিএনএ রিপোর্টেও মিলেছে এর সত্যতা।

বৃহস্পতিবার সকালে সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আবুল কাশেমের আদালতে এ মামলায় আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ছাত্রলীগকর্মী সাইফুর রহমানকে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আটজনের মধ্যে ছয়জন ধর্ষণে সরাসরি জড়িত, বাকি দুজন সহযোগিতা করেছে। এ মামলায় সবাই গ্রেপ্তার রয়েছে।

 

ধর্ষণে সরাসরি জড়িতরা হলো সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজন মিয়া। আর রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমের বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ডিএনএ রিপোর্টে সাইফুর ও রাজনের একক এবং বাকি চারজনের মিশ্র আলামত শনাক্ত হয়েছে। এ জন্য বিশেষজ্ঞ মতামতও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার সোহেল রেজা। বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, প্রায় ৪৯ জনের সাক্ষ্য ও সব আলামত পর্যবেক্ষণসাপেক্ষে এই অভিযোগপত্র গঠন করা হয়েছে। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রত্যাশা করেন তিনি।

ঘটনাক্রম : বিয়ের দুই মাসের মাথায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে আসেন মাইদুল ইসলাম (২৪) ও তার স্ত্রী। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সিলেট এমসি কলেজের প্রধান ফটক থেকে তাদের গাড়িসহ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে সাইফুরসহ ছয়জন। পরে এই দম্পতিকে মারধর করে তাদের কাছে থাকা টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয় ধর্ষকরা। আটকে রাখে প্রাইভেট কারও। ছাত্রাবাস থেকে ছাড়া পেয়ে টিলাগড় পয়েন্টে এসে পুলিশকে ফোন করেন নির্যাতিতার স্বামী। পরে পুলিশ গিয়ে ছাত্রাবাস থেকে ওই দম্পতির প্রাইভেট কার উদ্ধার করে এবং নির্যাতিতা তরুণীকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করে। তবে পুলিশের সময়ক্ষেপণে পালিয়ে যায় অভিযুক্তরা।

এ ঘটনায় রাতেই ছয়জনকে আসামি করে এসএমপির শাহপরাণ থানায় মামলা করেন নির্যাতিতার স্বামী। মামলায় সাইফুর রহমান (২৮), তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), অর্জুন লস্কর (২৫), রবিউল ইসলাম (২৫) ও মাহফুজুর রহমান মাসুমের (২৫) নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও তিনজনকে আসামি করা হয়।

এ ঘটনার পর দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। জনমতের চাপ মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে ধর্ষণবিরোধী আইনও সংশোধন করে সরকার। ধর্ষণকা-ের পর তৎক্ষণাৎ ধর্ষকদের আটকে ব্যর্থতা দেখিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে সিলেট মহানগর পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে আসামিদের পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরবর্তী সময়ে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব ও জেলা পুলিশের অভিযানে এজাহারভুক্ত ছয় আসামির সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় রাজন ও আইনুলকে। পাঁচ দিন করে রিমান্ড শেষে তারা সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

গত ১ ও ৩ অক্টোবর গ্রেপ্তার আটজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহের পর পাঠানো হয় ঢাকার ল্যাবে। অন্যদিকে গণধর্ষণের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ইতোমধ্যে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মহি উদ্দিন শামিম গঠিত বেঞ্চে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হলরুমে গত ৪ থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ ঘটনায় গণশুনানি হয়। পরে কমিটির সদস্যরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের গণধর্ষণের ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে গত ১৬ অক্টোবর ১৭৬ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্ট বেঞ্চে জমা দেওয়া হয়েছে। যার শুনানি হয় ২০ অক্টোবর। এদিন শুনানি শেষে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।

এদিকে গণধর্ষণের এ ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে ২৬ অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দোহাই দিয়ে কলেজ কমিটির এ প্রতিবেদনটি সিলগালা করে রাখেন।

গণধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে চার আসামির ছাত্রত্ব এবং সার্টিফিকেট বাতিল করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃতরা হলো সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান। এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।

মামলার প্রায় দুই মাসেও চার্জশিট জমা না পড়ায় আবারও সমালোচনার মুখে পড়ে এসএমপি। অবশেষে গত ৩০ নভেম্বর ধর্ষণের ঘটনার ডিএনএ প্রতিবেদন আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এসে পৌঁছায়। সর্বশেষ সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগে ছয়জনকে এবং ধর্ষণকাজে সহযোগিতার অপরাধে মোট আটজনের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। একই দিনে এ ঘটনার সময় ওই তরুণীর স্বামীকে মারধর, ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করা, নগদ ২ হাজার টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দ-বিধি ৩৪২/৩৮৫/৩২৩/ ৩৭৯/৩৪ ধারায় পৃথক আরেকটি মামলায় আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়।

এর আগে ধর্ষণ ঘটনার পর পরই এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আরও একটি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ মামলায় সাইফুর রহমান ও শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনিকে অভিযুক্ত করে গত ২২ নভেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে বলেও এসএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সূত্রঃদৈনিক আমাদের সময়

আপনার মতামত লিখুন :