‘শ্রমিকনেতা আব্দুল মান্নান এর অবদানেই আজকের শক্তিশালী শ্রমিকলীগ’
গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
প্রকাশিত হয়েছেঃ 08:45 AM, 12 October 20210SHARES
লেখকঃমোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট ও তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা, খুলনা।
শ্রমিকলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর সদস্য, ৭০’র জাতীয় পরিষদ ও ৭২’র গণপরিষদ সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জননেতা আব্দুল মান্নানের জন্ম ১৯২২ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জে। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন, আমৃত্যু সংগ্রামী প্রথিতযশা শ্রমিকনেতা আব্দুল মান্নানকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র ৫০ বছর পার না হতেই আমরা ভুলতে বসেছি। অথচ এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬৬’র ৬ দফা,৬৯’র গণঅভ্যুত্থান,৭০’র নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন মুজিববাদের কট্টর এই সমর্থক। অনেক ইতিহাসের জন্ম দেওয়া জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান যেন আজ ইতিহাস থেকেই বিস্মৃত!
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী,স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত শ্রমিক সমাজের ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে বাঙালীর আজন্ম লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের প্রয়াসে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্ত হয়ে আসার পর ১৯৬৯ সালের ১২ ই অক্টোবর প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান কে সভাপতি এবং আব্দুল মান্নানকে সাধারন সম্পাদক করে জাতীয় শ্রমিকলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে সংগঠনটির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত শ্রমিকলীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সহযোগী সংগঠন হিসেবে থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। শ্রমিকলীগ ৭০ সালের ৭ ই জুন আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা’ বাহিনী ও ছাত্রলীগের সাথে বঙ্গবন্ধুকে কুচকাওয়াজে অভিবাদন জানানোর মাধ্যমে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধকে শ্রমিকদের কাছে পৌছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরবর্তীকালে নিউক্লিয়াসের সাথে যুক্ত শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ এর তত্ত্বাবধানে ৭১’র মার্চের ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামে শ্রমিকলীগ সাধারন শ্রমিকদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক জননেতা আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে রাজপথে ছিল সরব।
শ্রমিকদের অধিকার ও দাবীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মে দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে মে দিবসকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে বরিশালের টাউন হল ময়দানে জেলা আওয়ামীলীগের জনসভায় জাতীয় পরিষদ সদস্য শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নান সামরিক আইন প্রত্যাহার করে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র মেনে নিয়ে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জোরালো দাবি জানান। অন্যথায় জনসাধারনের দাবি নস্যাৎ করার অপচেষ্টা নস্যাৎ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারন করেন। নির্বাচনে জনগণের দেওয়া রায় বাস্তবায়নে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ,সংগঠিত এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে আহবান জানান শ্রমিক নেতা মান্নান।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন।পহেলা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করার পর আবার স্থগিত করেন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের পূর্ব নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে ৭ ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশের ঘোষণা দেন। ৭ ই মার্চের সমাবেশ মঞ্চে হাজির হয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন সেই ঐতিহাসিক বানী-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
পাকিস্তানী শাসকের ভীত কেঁপে উঠল বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের ঘোষণায়।আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে লাগলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
২৩ শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা বাংলায় উড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা। ২৪ শে মার্চ আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, “আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ আর নয়।” ২৫ শে মার্চের কালরাত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু।বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে অতি গোপনে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা শুনে মানুষ ২৬ শে মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার জনাব মান্নান মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সীমান্ত পার হয়ে চলে যান ভারতে।
শরণার্থী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ক্যাম্প ইন চার্জ এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। অবশেষে ৩০ লক্ষ শহীদ আর আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ৯ মাস পর আসে বাঙালীর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীর দীর্ঘ ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। ২১ শে ডিসেম্বর মুজিব নগর সরকারের বেতার ও তথ্য বিভাগের দায়িত্ব পালনকারী এমএনএ আব্দুল মান্নান, মুজিব বাহিনীর দুই কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে শ্রমিকলীগ সাধারন সম্পাদক আব্দুল মান্নান দেশে ফিরে আসেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারি। ১২ ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহন করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পূনর্গঠনের কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞের একজন নিষ্ঠাবান,নির্লোভ এবং আদর্শিক কর্মবীর ছিলেন জননেতা আব্দুল মান্নান। ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে জয়দেবপুরে এক শ্রমিক সমাবেশে শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পূনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করতে শ্রমিকদের প্রতি আহবান জানান। মুক্তিযোদ্ধাদের অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণেরও অনুরোধ করেন মান্নান।
২৬ ডিসেম্বর ২৪ ঘন্টার সফরে কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পৌছান ভারতীয় সেনা প্রধান শ্যাম মানেকশ। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। ঐ প্রতিনিধি দলে ছিলেন আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতা এমএনএ আব্দুল মোমিন খান, গাজীপুরের এমপিএ ময়েজুদ্দীন, গাজী গোলাম মোস্তফা, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব সহ নেতৃবৃন্দ। প্রতিনিধি দলে অন্যতম নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রমিকলীগ সাধারন সম্পাদক এমএনএ আব্দুল মান্নান।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ ই জুলাই আদমজীনগরে বঙ্গবন্ধু প্রথম জনসভায় যান। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জননেতা শামসুজ্জোহার সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথির ভাষণে শ্রমিকদের দিকনির্দেশনা দেন। আঞ্চলিক সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ ভুলে কারখানা ও খামারে উৎপাদন বাড়াতে শ্রমিকদের প্রতি আহবান জানান বঙ্গবন্ধু। জেলাওয়ারী সংকীর্ণতা ভুলে সবাইকে বাঙালী পরিচয়ে পরিচিত হতে বঙ্গবন্ধু আহবান জানান। শ্রমিক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর আবেগঘন বক্তব্যে হাজার হাজার শ্রোতা কেঁদে ফেলেন। উক্ত সমাবেশে বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ৬৯’র গণঅভ্যূত্থানের মহানায়ক তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ এবং শ্রমিকলীগ সাধারন সম্পাদক জননেতা আব্দুল মান্নান।
শ্রমিকলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রমিক রাজনীতির পথিকৃত জননেতা আব্দুল মান্নান সৃষ্ট “লাল বাহিনী” ছিল একটি “স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী” যা ছিল জাতীয় শ্রমিক লীগের একটি শাখা।১৯৭২ সালে জাসদ সৃষ্টির পর থেকে সারাদেশে জাসদের গণবাহিনী কর্তৃক আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের হত্যা, নির্যাতন, গুম ও দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টির প্রতিবাদে সক্রিয় ছিল ‘লাল বাহিনী’। লাল বাহিনী ছিল তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্রোহ দমনের কাজ করত এই বাহিনী। এই বাহিনী নিয়ে অনেক অপপ্রচার ও সেসময় ছিল। লাল বাহিনী দেশের তেজগাঁও, টঙ্গী, আদমজী, কালুরঘাট, মোংলা বন্দর প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক শ্রমিক বিক্ষোভ দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নানের সাহসী নেতৃত্বে।
বঙ্গবন্ধুর প্রায় সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে জাসদ কর্তৃক সৃষ্ট অসংখ্য দাঙ্গা মোকাবিলায় লাল বাহিনী যে সাহসী ভূমিকা রেখেছিল তার নেপথ্যের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন আব্দুল মান্নান। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান উপহার দেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাংক, বীমা, কলকারখানা এবং বেশিরভাগ মিল জাতীয়করণ করা হয়। এতে দেশের প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ শিল্প সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণে আসে। এসময় শ্রমিকনেতা আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে জাতীয় শ্রমিকলীগ আগের চেয়ে অনেক বেশি সুসংগঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের সমর্থনে বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগ শীঘ্রই রাজনীতিতে একটি প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে।
আব্দুল মান্নানের সাহসী নেতৃত্বে লাল বাহিনীর সদস্যরা দেশের শিল্প অঞ্চলগুলিতে দেশবিরোধী শক্তির ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কৃত্রিম শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে সফল হয় এবং শ্রমিক শ্রেণির একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর শ্রমিক শ্রেণীর কল্যাণে শিল্প কারখানাগুলোকে জাতীয়করণ করা এবং সরকার কর্তৃক সৃষ্ট সামাজিক অর্থনীতির কারনে জাতীয় শ্রমিকলীগ ছাড়া অন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলো অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। শিল্পগুলি জাতীয়করণের পরে লাল বাহিনীর প্রধান আবদুল মান্নান ঘোষণা করেন লাল বাহিনী মূলত শ্রমিক শ্রেণীর সমাজতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে সহায়তা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
লাল বাহিনীর সদস্যরা আমেরিকান বিরোধী বক্তৃতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ফলে তারা বরাবরই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকায় আপোষহীন ছিলেন। আব্দুল মান্নানের একক নেতৃত্বে লাল বাহিনীর সদস্যরা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত সরকারবিরোধী বিক্ষোভে জড়িত শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে লাল বাহিনীর শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথাকথিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর হয়ে শোষণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণদের কঠোর হস্তে দমন করতে তাঁর ‘লাল ঘোড়া’ মোতায়েনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘লাল বাহিনী’কে সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ‘লাল ঘোড়া’ হিসেবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।লাল বাহিনীর উপর বঙ্গবন্ধুর এই আস্থা ও নির্ভরশীলতা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, প্রয়াত আব্দুল মান্নান বঙ্গবন্ধুর কতটা আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত ছিলেন।
বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের প্রভাবশালী ত্রয়ী ছিলেন আব্দুল মান্নান, মোহাম্মদ শাহজাহান এবং রুহুল আমিন ভূঁইয়া। জাসদ গঠনের অব্যবহিত পরে অর্থাৎ ৭২ এর ডিসেম্বরে হাজারো অনুগামীদের নিয়ে নবগঠিত জাসদের সমর্থনে শ্রমিকলীগ ত্যাগ করেছিলেন আব্দুল মান্নানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহজাহান ও রুহুল আমিন ভুঁইয়া। ফলে একদিকে শ্রমিকলীগকে পূনর্গঠন অন্যদিকে জাসদের সর্বহারাদের সরকারবিরোধী নৈরাজ্য মোকাবিলা দুটিই দক্ষতার সাথে সম্পাদনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু বিশ্বস্ত সহচর আবদুল মান্নান। মোহাম্মদ শাহজাহান ও রুহুল আমিন ভূঁইয়া জাসদের নতুন শ্রমিক ফ্রন্ট গঠন করেন। শুরু থেকেই বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের সাথে জাসদ সমর্থিত শ্রমিক ফ্রন্টের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। কিন্তু মুজিববাদী আব্দুল মান্নান দৃপ্তকণ্ঠে সেদিন মুজিববাদের পক্ষে সাহসী উচ্চারণ করছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি সেদিন মুজিববাদবিরোধী নৈরাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন- “মুজিববাদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করলে আমি তাদের জিহ্বা কেটে দিব।”
জননেতা আব্দুল মান্নান বিশ্বাস করতেন মুজিববাদ অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শোষিত,বঞ্চিত ও অবহেলিত বাঙালির মুক্তির শ্রেষ্ঠ দর্শন। মুজিববাদের প্রশ্নে তিনি বরাবরই আপোষহীন ছিলেন।বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তো নয়ই বরং ৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের নির্মম ট্রাজেডির পর ও বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেইমানি করেন নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকেই বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আর জেনারেল জিয়ার অনুকম্পা নিয়ে ভয়ে কিংবা চাপে পড়ে মোশতাক-জিয়ার সরকারে যোগদান করে নিজেদের চলার পথ সুগম করেছেন। কিন্তু লাল মান্নান শ্রমিকদেরকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে সংগঠিত করতে গিয়ে সরকারের রোষানলে পড়ে বছরের পর বছর অত্যাচার, নির্যাতনের বন্দিদশা হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন।
এভাবে মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পদক্ষেপে, স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ রাষ্ট্র পূনর্গঠনে আমৃত্যু অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন আব্দুল মান্নান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরকালের জন্য পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন এক ঝাঁক আদর্শিক মুজিববাদী তার রক্তের উত্তরসুরীকে, যারা তার দেখানো পথে শত বাধা, বিপত্তি, অত্যাচার, নির্যাতন, হামলা, মামলাকে মোকাবিলা করে যুগ যুগ ধরে মুজিব আদর্শের প্রশ্নে রয়েছেন অবিচল, অটল। তাদেরই একজন হলেন জননেতা আব্দুল মান্নানের ভাতিজা মুজিব আদর্শের রাজনীতির রাজপথের পরিক্ষীত সাহসী সৈনিক তসলিম আহমেদ আশা। আশা ৮০’র দশকে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত প্রত্যয়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের পতাকাতলে শামিল হন। অতপর যুবলীগের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন যুক্ত আশা বর্তমানে খুলনা মহানগরের অন্তর্গত সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামীলীগের সফল সাধারন সম্পাদক।
দীর্ঘ প্রায় ৩৫-৩৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বহুবার অত্যাচার, নির্যাতন, হামলা, মামলার স্বীকার হয়েছেন এমনকি একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু মুজিববাদে অটল থেকেছেন প্রয়াত আব্দুল মান্নানের আদর্শিক রক্তের এই যোগ্য উত্তরসুরি।শুধু তসলিম আহমেদ আশা নন, প্রয়াত জননেতা আব্দুল মান্নানের পুরো পরিবারই যুগ যুগ ধরে মুজিববাদের ঝান্ডা ধরে রেখেছেন আব্দুল মান্নানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। সময়ের বিবর্তনে জাতীয় বীর আব্দুল মান্নানের অবদান আমরা ভুলে গেছি। বর্তমান প্রজন্ম হয়ত জানেই না জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সম্পর্কে, তার সংগ্রামী জীবন ও দেশপ্রেম সম্পর্কে। তাই রাষ্ট্রের কাছে দাবি আব্দুল মান্নানের মত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সংগ্রামী জীবন ও কর্মকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি আদর্শিক নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাওয়া। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রামী জননেতা আব্দুল মান্নানকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই শ্রমিকলীগের ৫২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।