মেহেরপুর গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের মহামানব যার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা রয়েছে। গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের ভিত যার হাত দিয়ে রচিত হয়েছে। গাংনী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর নাম জনাব বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল হক ( সাবেক এমপি)। যিনি গাংনী বাসির কাছে অনুস্মরণীয়।
১৯১৫ সালের ১ আগস্ট মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার মোহাম্মদপুর সবুজ গাছগাছালি ঘেরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা জনাব মুজিব উদ্দিন বিশ্বাস ও মাতা মোছাঃ জিউজান নেছা।
তিনি প্রচণ্ড ও প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। ১৯৩১ সালে মেহেরপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হোন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৫ সালে সেখান থেকে তিনি বি.এ পাশ করেন সফলতার সাথে।
কর্ম জীবন শুরু করেন অত্যন্ত সফলতার সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম ডাক বিভাগে চাকুরি গ্রহণের মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন।
তিনি অসীম সাহসিকতা ও যোগ্যতার কারণে ১৯৩৯ সালে চাকরি ছেড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য ব্রিটিশ ভারতের সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি উক্ত সামরিক বাহিনীর কমিশন্ড অফিসার ছিলেন। উল্লেখ্য যে তিনি ব্রিটিশ ভারতের সামরিক বাহিনীর অর্ডিন্যান্স কোরের দ্বিতীয় বাঙ্গালী কমিশন্ড অফিসার ছিলেন। ভারতের সেন্ট্রাল প্রদেশের কার্টনি সেন্টার হতে ৯ মাস দূরুহ অফিসার ট্রেনিং সম্পন্ন করে কমিশন্ড প্রাপ্ত অফিসার পদে যোগদান করে ব্রিটিশ ভারতের নিউ দিল্লি, পুনে, লক্ষ্ণৌ, বোম্বে, জব্বলপুর,লাহোর সহ বিভিন্ন ডিপোতে কাজ করেন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তিনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হন।
পরবর্তীতে তিনি আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কাজ করেননি। কারণ উল্লেখ করা হয় যে, তিনি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না অপরদিকে তিনি জন্মস্থানের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে চান। তাই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী থেকে পদত্যাগ করে ফিরে আসেন নিজ গ্রাম মোহাম্মদপুরে। প্রতিষ্ঠা করেন হাজী ভরস উদ্দিন ইনস্টিটিউশন। সেখানেই তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে ৩৫ বছর শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ধারণ করেছিলেন, “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড “। সে জন্যই নিজ এলাকার মানুষকে সুশিক্ষাই শিক্ষিত করতে,আলোকিত সমাজ গড়তে শিক্ষার গুরুত্ব বেশি দিয়েছিলেন। তাই এমন সোনার চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে একটুও ভাবেননি। উল্লেখ্য যে, এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর তাঁর সংস্পর্শে এসে অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পেশায় নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।
রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগে সংযুক্ত হোন। তখনকার রাজনীতি এত সরল রেখায় ছিলো না,এতটা মসৃণ পথ ছিলো না। তবুও বঙ্গবন্ধুর আহবানে দেশের মানুষের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক কর্মী হয়ে রাজনীতি শুরু করেন।
১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর গাংনী থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর হাত ধরেই গাংনী থানা আওয়ামী লীগের সফল যাত্রা শুরু হয়। তিনি পায়ে হেঁটে, সাইকেল চালিয়ে গাংনীর প্রতিটি গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। সেই সময়ে সমসাময়িক প্রবীণ নেতা কর্মীদের মুখ থেকে জানা যায়, তিনি কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। কখনো মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি। এমনকি শত্রুদের সাথেও তিনি হাসি মুখেই কথা বলতেন। আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রম,মেধা ও ধৈর্য্য কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গাংনী থানা আওয়ামী লীগকে।
তখন ১৯৭০ সাল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেন। বিপুল ভোটে তিনি বিজয়ী হয়ে ততকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হোন। ১৯৭০-১৯৭২ সাল পর্যন্ত সফলতার সাথে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। উল্লেখ্য যে সামরিক বাহিনীতে ট্রেনিং থাকার সুবাদে তিনি সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক হিসেবে বেতাই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট করতেন এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে সফলতার সাথে রাজনীতি করেন।তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুমোদনে স্বাক্ষর করেন।
স্বাধীনতার পর মেহেরপুর -২ গাংনী আসনে নৌকার প্রতীক নিয়ে তিনিই প্রথম নৌকার এমপি, আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হন ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি মানুষের জন্য কাজ করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে কোথাও কোন দাগ পড়েনি। দূর্নীতি, অন্যায়, অবিচারের সাথে কখনো আপোষ করেননি। লোভ তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। এই গাংনীতে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সবকিছুর বিচার বিবেচনায় সেই সময়ের নেতা কর্মীরা তাঁকে গাংনীর অবিসংবাদিত নেতা বলে স্বীকার করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৫ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর এক কন্যা সেলিনা আক্তার বানু ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত এমপি ছিলেন। এবং একমাত্র পুত্র ডাক্তার এএসএম নাজমুল হক সাগর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করে এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে সততার সাথে চাকরি করছেন। জনাব নাজমুল হক সাগর ছাত্র জীবনে থাকাকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সদস্য ছিলেন। সেই সময়ের ছাত্রলীগের অনেক নেতা কর্মীরা তার এখনো সুনাম করেন।
গাংনীর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জনাব মোহাম্মদ নুরুল হকের(সাবেক এমপি) নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই মহান নেতাকে কোনদিন ভুলবে না গাংনী বাসি। ১৯৯৮ সালের ২৭ আগস্ট তিনি পরলোক গমন করেন। গাংনী উপজেলা বাসি তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। এই মহান নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখকঃ আব্দুস সামাদ সোহাগ
বি.এ ( সম্মান), এম.এ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রামঃ বাঁশবাড়িয়া কলোনি পাড়া
উপজেলাঃ গাংনী, জেলাঃ মেহেরপুর।
তথ্যসূত্রঃ ১। মেহেরপুর জেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।
২। ৩য় জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ সদস্যদের নামের তালিকা, জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশ।
৩। পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার।
তারিখঃ ২২ আগস্ট, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।