মেহেরপুরে নাপিতের পেশা হারিয়ে যেতে বসেছে
মেহেরপুর থেকে আগের দিনের সেই ইটের উপর কিংবা কাঠের ফিড়ার উপর বসে চুল দাড়ি কামানো নাপিতের পেশা হারিয়ে যেতে বসেছে। শৈশবে দেখেছি বিশেষ করে আশি ও নব্বই দশকে মেহেরপুর জেলা শহর, গাংনী উপজেলা শহর, বামুন্দী বাজার, লক্ষ্ণিনারায়নপুর, মাইলমারীসহ বিভিন্ন এলাকার হাট-বাজারসহ গ্রামে গ্রামে গিয়ে নাপিতেরা ইট কিংবা কাঠের ফিড়ার উপর বসিয়ে মানুষের চুলদাড়ি কামাতেন। প্রতি মাথার চুল কামাতে টাকা লাগতো ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা। এমনও দেখা গেছে টাকার পরিবর্তে ধান ও গমসহ অন্যান্য ফসলের সিজনে নাপিতেরা তাদের চুল কাটার পাওনা হিসেবে ধান, গম ও মশুরিও নিয়েছেন তাদের মজুরি হিসেবে।
কালের বিবর্তনে সেসব নাপিতেরা তাদের পেশায় তেমন একটা লাভজনক না হওয়ায় অনেকে অন্য পেশাকেও জীবিকা নির্বাহের জন্য বেছে নিয়েছেন। কেউ কেউ বংশীয় পেশাকে টিকিয়ে রাখতে বাপ-দাদার পেশাকে এখনও টিকিয়ে রেখেছেন।
গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নের লক্ষ্ণিনারায়ণপুর ও মাইলমারী গ্রামের পেশাদার নাপিত কলম, মওলা ও অফেজ আলী মারা গেলেও পৈতৃক পেশাকে টিকিয়ে রেখেছেন তাদের ছেলে আকবর আলী, তাইজুল ইসলাম ও শরিফ হেসেন। এ পেশা তেমন একটা লাভজনক না হলেও পৈতৃক পেশাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তারা।তাইজুল ইসলাম হাট-বাজারে ২৫-৩০ টাকায় মাথার চুল কামিয়ে থাকেন, শরিফ হেসেন দিনমজুর খাটার পাশাপাশি অবসরে কিংবা বৃষ্টির দিনে ৩০-৪০ টাকায় চুল কামিয়ে থাকেন।
তবে আকবর আলী জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, এ পেশা লাভজনক না হলেও বংশীয় ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে একটি ভালো অবস্থান তিনি তৈরি করে নিয়েছেন।
বাবা বেঁচে থাকতে গ্রাম গন্জে চুল কামিয়ে গেলেও আমি হাল ধরেছি ভিন্ন ভাবে। তিনি বলেন, মাইলমারী বাজারে ১ হাজার টাকায় মাসিক ভাড়ায় একটি দোকান নিয়েছি। মহান আল্লাহ’র রহমতে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জনের চুল দাড়ি এখানে কামানো হয়। একা সম্ভব না হওয়ায় আরও ২ জন কর্মচারী নেওয়া হয়েছে সহকারী হিসেবে। তিন জনেই বর্তমানে চুলদাড়ি কামানোই নিয়োজিত। নিয়োগ কৃত দু’জনকে জনপ্রতি মাসে ১৫ হাজার করে ২ জনকে ৩০ হাজার টাকা, দোকান ভাড়া ১ হাজার এবং অন্যান্য খরচ বাদ দিয়েও তিনি প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা উপার্জন করছেন।
আকবর আলী আরো জানান, এ বাজারে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি বারবার শপ গড়ে উঠলেও প্রায় সকলেই অলাভজনক হওয়ার কারণে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। কিন্ত বাবার পেশাকে মানুষের ভালোবাসাতে আমি আজও ধরে রেখেছি। কালের বিবর্তনে সবকিছুই আধুনিকায়ন হচ্ছে। আমার দোকান নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানোর। অচিরেই আধুনিকতার ছোঁয়া পাবে আমার দোকানও, শুধু অপেক্ষার পালা।
তবে ছোট্ট পরিসরে চালু করার পর ছোট্ট আয়নার পর বিশাল আয়নার ব্যবস্থা হয়েছে। কাঠের চেয়ারের পর উন্নতমানের চেয়ারের ব্যবস্থা, তাছাড়া উন্নতমানের প্রসাধনীর ব্যবহার ছাড়াও শহরের মতো এখানেও নানাভাবে মাথা, ঘাড় ও শরীর মাসাজের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে করে বাড়তি কোন অর্থ নেওয়া হয়না। এদিকে শহরের মতো বিভিন্ন ডিজাইনে চুলও কামানো হয়ে থাকে, যেভাবে তার কাটতে চায়। এখানে বিভিন্ন স্টাইলের ছবি দেওয়া রয়েছে। চাহিদা অনু্যায়ী কেটে দেওয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে মজুরি একটু বেশি দিতে হয় কারণ সময় বেশি লেগে যায়। তিনি বলেন ৪০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০ টাকায় পর্যন্ত চুল কামানো হয়ে থাকে।
আগামীতে সিংগাপুর স্টাইলে এবং উন্নত প্রযুক্তিতে চুলদাড়ি কামানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
চুল কামাতে আসা মাইলমারী এলাকার বিশ্বাস ট্রেডার্স এর স্বত্ত্বাধিকার ইসাহক আলী জানান, আমরা যেটাই করিনা কেন, অতীতের কথা ভুলে নয়। অতীতের কথা আমাদের মনে রাখা জরুরি। আমাদের অতীত ঐতিহ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে হবে।