মেহেরপুরের পানিতে ভয়াবহ আর্সেনিক

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  09:38 PM, 27 March 2023

রাব্বি আহমেদঃ মেহেরপুর জেলার এক আতঙ্কের নাম আর্সেনিক। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় জেলার মানুষ জেনে শুনেই এ বিষ পান করে চলেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সদর উপজেলার আলমপুর গ্রামে। আর্সেনিক আতঙ্কে দিশেহারা পুরো গ্রামবাসী।এছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের অস্থিত্ব পাওয়া গেছে সদর উপজেলার আমঝুপি, বেলতলাপাড়া, পৌর এলাকার স্টেডিয়াম পাড়া, বুড়িপোতা, উজলপুর ও সুবিদপুর; গাংনী উপজেলার মানিকদিয়া, ভোলাডাঙ্গা, সহগলপুর ও তেঁতুলবাড়িয়া এবং মুজিবনগর উপজলার তারানগর ও জয়পুর গ্রামের টিউবওয়েলের পানিতে। নিরাপদ পানি না পেয়ে নিরুপায় হয়েই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করায় আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ওইসব গ্রামের শতশত মানুষ।এর সংক্রমন থেকে বাঁচতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছে আক্রান্ত এলাকার মানুষ। এ বিষয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি মেহেরপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দীন।

তবে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেছে কিনা তা তাদের জানা নেই। এলাকাবাসী ও জন-প্রতিনিধিদের হিসেবে, ১৯৯০ দশক থেকে এ পর্যন্ত আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে জেলার এক হাজার পাঁচ-ছয় শতাধিক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। আলমপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে কিছু কিছু রিং টিউবওয়েল, কয়েকটি এনজিও থেকে নিরাপদ পানির প্লান্ট স্থাপন করা হলেও সেগুলোর বেশিরভাগই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আবার কোনো কোনোটি বিদ্যুৎ সংযোগ এবং সংস্কারের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। ফলে নিরাপদ পানি না পেয়ে ভয়াবহ মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে এ গ্রামের মানুষ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়,১৯৯০ দশকের আগে আর্সেনিক সম্পর্কে এ জেলার মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। কিছু কিছু মানুষের ত্বক খসখসে হওয়া ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় চিকিৎসা করতে গিয়ে আর্সেনিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এরপর গণমাধ্যমে এ খবর প্রচারিত হলে মানুষ আর্সেনিক সম্পর্কে ধারণা পায়। আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার শতকরা ৯০-৯৫% টিউবওয়েলে ভয়াবহ মাত্রায় আর্সেনিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে এ টিউবওয়েলগুলো লাল রং করে দেয়া হয়েছে। মানবদেহের জন্য আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ০.৫ (শূণ্য দশমিক পাঁচ) পিপিবি। কিন্তু এখানকার টিউবওয়েলগুলোতে ২০০-৩০০ পিপিবি পর্যন্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। জানা গেছে, আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে গত ১০ বছরে আলমপুরে মারা গেছে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক। এখনো এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। আক্রান্তদের মধ্যে শতাধিক মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরও অবস্থার পরির্বতন না হওয়ায় বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

মুজিবনগর উপজেলার তারানগর গ্রামের আব্দুল মালেক জানান, স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থা করতে পারেনি। স্বাস্থ্য বিভাগও তেমন কোনো পরামর্শ দেয় না। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকার ফলে চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।

গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন জানান, গ্রামবাসীরা আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়ায় পাশের কোনো গ্রামের মানুষ তাদের সঙ্গে মেলামেশা-আত্মীয়তা করতে চায় না। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি বিয়েও ভেঙ্গে গেছে।আবার বিয়ের পর কয়েকজন নববধু বিষয়টি টের পেয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসেনি।

একই গ্রামের আনোয়ার হোসেন সরকারের কাছে দাবি করে বলেন- আমরা এদেশের নাগরিক। তাই সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার আমাদেরও আছে। সরকার দ্রুত আমাদের জন্য সাপ্লাইয়ের পানির ব্যবস্থা করবে এটাই তাদের প্রত্যাশা। অন্যথায় গ্রামের সব মানুষকে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে।

সদর উপজেলার আলমপুর গ্রামের আবুল কালাম জানান, আমার পরিবারের সাতজন সদস্য আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারিভাবে কোন সাহায্য সহযোগিতা বা কোন খোঁজ খবর নেয়নি। আমরা বাঁচতে চাই।

মেহেরপুর সির্ভিল সার্জন ডা.জওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী জানান, খবর পেয়ে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত মানুষের তালিকা করে ওষুধ সরবারহ করি। একটি বিদেশী সংস্থা আমাদের সহযোগিতা করে আসছিল। ওই সংস্থাটির আর্সেনিক প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়ার ফলে আমরা কাজ করতে পারছি না। তবে আমাদের কাছে যারা আসে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি।

মেহেরপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দীন সাথে তথ্য ও বক্তব্য নেয়ার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আপনার মতামত লিখুন :