“মেজর সিনহা হত্যার বিচার, দেশে আইনের শাসনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত”’
বহুল আলোচিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। আজ বিকেল ৪টার দিকে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। টেকনাফ মডেল থানার আলোচিত বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব, পুলিশের সোর্স কক্সবাজারের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিন। তবে এপিবিএনের তিন সদস্যসহ ৭ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে। রায়ে মেজর সিনহার পরিবার এবং দেশবাসী স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এবং বিচার বিভাগ, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন। উল্লেখ্য ২০২০ সালের ৩১ জুলাই মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা হত্যার পর ৫ আগস্ট তার বোনের দায়েরকৃত মামলায় ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালতে মামলার চার্জ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিচারকাজ শুরু হয়। ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। এ বছরের ৯-১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে ক্রসফায়ারের নামে নির্মমভাবে হত্যা এবং অপরাধী বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই লিয়াকত, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস সহ অন্য অপরাধীদের ব্যাপারে দেশবিরোধী অপচক্র দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির সুস্পষ্ট অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ওসি প্রদীপ কুমার দাস সম্পর্কে একটি মহল অপপ্রচার করে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর অপচেষ্টা চালিয়েছিল। অপরাধীর পরিচয় অপরাধী। সে কোন ধর্মের অনুসারী সেটি মূখ্য বিষয় হতে পারে না। অথচ দেশবিরোধী অপচক্র ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে ভারতীয় নাগরিক বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, মনগড়া প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল। সরকারের সহায়তায় ওসি প্রদীপ বিদেশে চলে গেছে এমন প্রচার ও করা হয়েছিল হত্যাকান্ডের পরপর। ঐ অপচক্রের ভাষায় ওসি প্রদীপ যেহেতু ভারতের এজেন্ট সেহেতু সরকার তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারবেনা মর্মে হত্যাকান্ডের পর প্রচার চালানো হয়েছিল।
ওসি প্রদীপকে নিয়ে যারা অপপ্রচার চালিয়েছিল তাদের জানা ছিল এই সরকারের আমলেই বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় হাজার হাজার বিডিআর জওয়ানের আদালতের রায়ে শাস্তি হয়েছে। হাজার হাজার জওয়ান চাকুরীচ্যূত হয়েছে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকারের আমলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় পুলিশের সাবেক তিনজন আইজিপি শহুদুল হক, মোহাম্মদ আশরাফুল হুদা এবং খোদাবক্স চৌধুরী সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে আছেন। সাবেক ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই এর সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আব্দুর রহিম সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের রায় মাথায় নিয়ে কারাগারে আছেন। সর্বোচ্চ আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছেন। বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় মাথায় নিয়ে বিদেশে পলাতক জীবন যাপন করছেন। বিদেশে পলাতক অবস্থায় সম্প্রতি হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর একটি সংবাদ ও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ৬ আসামির ফাঁসি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কার্যকর হয়েছে। অথচ এদেশের মানুষ একসময় ভাবত বাংলাদেশের মাটিতে এদের বিচার কোনদিন হবে না। এই স্বঘোষিত ঘৃণ্য খুনীদের খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা-নিজামীরা ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের আওতার বাইরে রেখে বিভিন্ন সময় প্রটেকশন দিয়েছিল। বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছিল। নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছিল, এমপি বানিয়েছিল, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়েছিল। আইনের শাসনকে ভুলুন্ঠিত করেছিল। অথচ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার করেছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী কুখ্যাত গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, আব্দুল আলিম, কামারুজ্জামান, মীর কাশিম, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী গংদের আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ড কিংবা যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। অনেকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। কেউ কেউ সাজা মাথায় নিয়ে কারাগারে বন্দী অবস্থায় বয়সজনিত কারনে মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ কেউ কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। মাত্র এক যুগ আগেও কেউ ভাবেনি এই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কোনদিন এদেশের মাটিতে হবে। অথচ শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবতাবিরোধীদের বিচার করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধীদের বিচার করে শেখ হাসিনা জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং ন্যায় বিচারের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খুনী মোস্তাক, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা-নিজামীদের দ্বারা যা ভূলুন্ঠিত হয়েছিল।
দেশবিরোধী অপচক্র অতীতে নারায়নগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর ও অপপ্রচার চালিয়েছিল। অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী মোফাজ্জ্বল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা এবং নূর হোসেন সরকারী দলের কাউন্সিলর হওয়ায় তাদের কিছুই হবে না বলে বিভিন্ন মনগড়া অপপ্রচার করেছিল। কিন্তু ঐ মামলায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ সহ ১৬ জন র্যাব কর্মকর্তা ও কাউন্সিলর নূর হোসেনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হয়েছে। অন্যান্য আসামীদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। আসামীদের সবাই কারাগারে রয়েছে। চাঞ্চল্যকর বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অভিযুক্ত দুই ছাত্রলীগ নেতা শাকিল ও রাজনের মৃত্যুদন্ড এবং ১৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল আছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার হয়েছে। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় হয়েছে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা বা কর্মি হওয়ার পরেও সরকার কিংবা আদালত তাদের প্রতি কোন ধরনের অনুকম্পা দেখায়নি। সিলেটের চাঞ্চল্যকর শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামী সহ চারজনের মৃত্যুদন্ড হয়েছে আদালতের রায়ে। এই মামলার প্রধান আসামী হত্যাকান্ডের পর সৌদি আরব পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে অল্পদিনের মাথায় সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় তাকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। খুলনার শিশু রাকিবকে কম্প্রেশার মেশিনের সাহায্যে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা মামলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে নিম্ন আদালতে রায় দেওয়া হয়। এই মামলার প্রধান দুই আসামীকে আদালত মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছে। ফেনীর চাঞ্চল্যকর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় প্রধান আসামী মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা এবং সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রুহুল আমিন সহ ১৬ আসামীকে মৃত্যুদন্ড এবং ওসি মোয়াজ্জেমের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ৮ বছরের কারাদন্ড এবং দশ লক্ষ টাকা জরিমানা হয়েছে।
বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যা মামলায় স্ত্রী মিন্নি সহ অপরাধীরা বিচারের আওতায় আছে। প্রধান আসামী নয়ন বন্ড আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। চট্টগ্রামের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা মামলার আসামীরা কারাগারে আছে।বিচারকার্য প্রায় সমাপ্তির পথে।সরকারের গত মেয়াদে দু’জন প্রভাবশালী মন্ত্রী ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জ্বল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে বিচারাধীন মামলার বিষয়ে এখতিয়ার বহির্ভূত বক্তব্য দেওয়ায় আদালত অবমাননার দায়ে আদালতে তলব করা হয়েছিল। আদালতে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে রেহাই পান। শেখ হাসিনার গত সরকারের আমলে দুদকের মামলায় ককক্সবাজারের আলোচিত এমপি আব্দুর রহমান বদির তিন বছরের কারাদন্ড হয়েছিল। এমপি থাকা অবস্থায় তাকে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হয়েছিল। টাঙ্গাইলের গত সংসদের এমপি আমানুর রহমান খান রানা একটি হত্যা মামলায় এমপি থাকা অবস্থায় টানা ৩৪ মাস জেলে ছিলেন। অতঃপর জামিন পান। গত সরকারের আমলে পাবনার ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর পুত্র উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিরহান শরীফকে চার সাংবাদিক পেটানোর মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন।
বাংলাদেশে একজন মন্ত্রীর ছেলের অপরাধ করে জেলে যাওয়ার নজির কি অতীতে ছিল? অনেক সাবেক মন্ত্রী, এমপি এবং আমলার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ ওঠায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি, সেক্রেটারিকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।যদিও সেই অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। ক্যাসিনোকান্ডে নাম আসায় যুবলীগ চেয়ারম্যান এবং স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি, সেক্রেটারিকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি জনপ্রিয় যুবনেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট এখনও জেলে অন্তরীণ। সরকারি দলের নেতারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানি করলেও কি তাদের আইনের আওতায় কখনও আনা হয়েছে অতীতে? এ ধরনের নজির একমাত্র বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন।
এই সরকারের আমলে কোন প্রভাবশালীকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়নি। অপরাধ করে কেউ পার পায়নি। দেশের মানুষ এ সবকিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। এ কারনে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পরিপূর্ণ আস্থা আছে। গুটিকয়েক অপপ্রচারকারী, ষড়যন্ত্রকারীর কোন ধরনের চক্রান্ত, সাম্প্রদায়িক উস্কানি কিংবা ভারতবিরোধী, ভারতবিদ্বেষী অপপ্রচারে মানুষ এখন আর বিশ্বাস করে না। কাজেই ষড়যন্ত্র, চক্রান্তকারীদের প্রতি সনির্বন্ধ আহবান চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচারের পথ থেকে সরে আসুন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার উন্নয়ন, সমৃদ্ধি আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রায় শামিল হোন।
মোঃ নজরুল ইসলাম, কলাম লেখক ও তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা