“মনোনয়ন নিয়ে গাংনী আওয়ামী লীগের বিভাজনের রাজনীতির শেষ কোথায়”
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, থাকবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও। তবে সেটা হবে অবশ্যই আদর্শের। প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে হবে দলের গঠনতন্ত্র মানা না মানার। প্রতিযোগিতা হবে জনকল্যাণমূলক ও জনসেবামূলক কর্মকান্ডের। প্রতিযোগিতা হবে দল ও আদর্শের প্রতি নিঃস্বার্থ আনুগত্যের। রাজনীতির ভিত্তি হতে হবে সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দলের গঠনতন্ত্র এমনকি মানবিক মূল্যবোধ উপেক্ষিত হয়ে যখন কেবলমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ, নিজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি কিংবা নেতা, জনপ্রতিনিধি হওয়া মূখ্য হয়ে যায় তখন রাজনীতিতে বিভেদ এবং দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। বর্তমান গাংনীর রাজনীতি এর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
মেহেরপুরের গাংনী ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির ঘাঁটি। ১৯৭০ এর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এবং ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের সময়েও আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতেছিল গাংনীর মাটিতে। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ এবং ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতেছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নূরুল হক। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খুব সামান্য ব্যবধানে হেরেছিলেন নৌকার প্রার্থী হিসাব উদ্দীন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জনমতকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা হিসাব উদ্দীনকে মনোনয়ন দিলে প্রথম গাংনী আওয়ামী লীগে বিভেদের রাজনীতি শুরু হয়। তবে সেই বিভেদ অতটা প্রকট ছিলনা। কারণ উপজেলা আওয়ামী লীগে এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের উপর মকবুল হোসেনের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে আওয়ামী লীগের ৮০% এর বেশি নেতাকর্মী এবং ৯০- ৯৫% সাধারন সমর্থক সেই নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে গিয়ে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী মকবুল হোসেনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে তার বিপুল বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। বিএনপির প্রার্থী, সদ্য সাবেক সাংসদ আব্দুল গনি বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিল সেই নির্বাচনে। দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী সেদিন মকবুল হোসেনের পক্ষে থাকায় নৌকার প্রার্থী হিসাব উদ্দীনের শোচনীয়ভাবে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। নির্বাচনের পরে নৌকার প্রার্থী হিসাব উদ্দীন গাংনী থেকে একপ্রকার বিতাড়িত হন। ফলে ঐ নির্বাচনের পর ক্ষণস্থায়ী বিভেদের রাজনীতির সমাপ্তি ঘটেছিল। মকবুল হোসেন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেও নেতাকর্মীরা সেদিন তাকেই বেছে নিয়েছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী মকবুল হোসেন সরকার গঠনে শেখ হাসিনা কে সমর্থন দিয়ে সেদিন প্রমাণ করেছিলেন তিনি আওয়ামী লীগেরই একজন।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড আগের ভুল সিদ্ধান্তকে শুধরে নিয়ে গণমানুষের নেতা মকবুল হোসেনকে মনোনয়ন দিয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে মকবুল হোসেন এমপি থাকাকালীন রাস্তাঘাট নির্মাণ সহ প্রত্যাশিত অবকাঠামো উন্নয়ন করতে না পারা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চক্রান্তে সেই নির্বাচনে গাংনীর আওয়ামী লীগ পরিবার ঐক্যবদ্ধ থাকলেও মকবুল হোসেনের মত শক্তিশালী, জনপ্রিয় প্রার্থী পরাজিত হন। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকান্ড কিছুটা স্থবির হয়ে পড়লে দলকে সংগঠিত করতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির রাষ্ট্র ক্ষমতার মেয়াদে ২০০৪ সালের সেই সম্মেলনে উপজেলার বাঘা বাঘা নেতাদের হারিয়ে কাউন্সিলরদের ভোটে সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে সাবেক ছাত্রনেতা সাহিদুজ্জামান খোকন এবং এম এ খালেক।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের দিকনির্দেশনায় নতুন কমিটির নেতৃত্বে গাংনীতে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তোলে। বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও রাজপথ ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। কিন্তু বিপত্তি বাধে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় সংসদের নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এম এ খালেক মনোনয়ন পেলে। মকবু্ল হোসেনের অনুসারীরা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তার সমর্থক কর্মিরা খালেকের নির্বাচনী প্রচারণায় পদে পদে বাধা দেয়। নির্বাচনী অফিস এবং প্রচারণার মাইক ভাঙচুর করা হয়। যদিও ৯৬’র নির্বাচনে মকবুল হোসেন কে জেতাতে খালেকের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে ওয়ান ইলেভেন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু গাংনীর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মকবুল ও খালেক দুটি পৃথক বলয়ের সৃষ্টি হয় এবং স্থায়ী বিভেদের সৃষ্টি হয়।
ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার হলেও গাংনীতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মকবুল হোসেন খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। মকবুল হোসেন গ্রুপের পক্ষ থেকে এই পরাজয়ের জন্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজ্জামান খোকন এবং সাধারন সম্পাদক এম এ খালেক কে দায়ী করা হয়। তবে ঐ নির্বাচনে খোকন কিংবা খালেক কেউই প্রার্থী হননি কিংবা প্রকাশ্যে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধাচরণ করেন নি। খোকন এবং খালেকের পক্ষ থেকে সে সময় দাবি করা হয় তারা দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেই সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগ দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আবারো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে দলের প্রার্থী এ্যাডভোকেট এ. কে. এম. শফিকুল আলমের বিজয় ছিনিয়ে আনার মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের পরাজয়ের গ্লানি থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের রায়ে বাতিল হয়ে যাওয়ায় সরকারের মেয়াদ শেষে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয় এম এ খালেককে। সে নির্বাচনে মকবুল হোসেন আবারো দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হন এবং দল মনোনিত প্রার্থী এম এ খালেককে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মত এমপি নির্বাচিত হন। ফলশ্রুতিতে খালেক-মকবুল বিভেদ চূড়ান্ত আকার ধারন করে। মকবুল হোসেন দ্বিতীয় মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হয়ে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণে আগের মেয়াদের ব্যর্থতা ঘুচিয়ে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড করেন। স্কুল, কলেজে অসংখ্য ভবন সহ অসংখ্য রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট নির্মাণ করেন। গাংনী উপজেলার অলিগলির প্রায় সমস্ত রাস্তা পাকা করতে সমর্থ হন তিনি। তবে মকবুল হোসেন বলয়ের নেতাদের দাপটে উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই নেতা খালেক-খোকন অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এতে করে কিছুটা ইমেজ সংকটে পড়েন মকবুল হোসেন। দলের নেতাকর্মীদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই নেতার। বারবার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া মকবুল হোসেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। মনোনয়ন বঞ্চিত হন ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মকবুল হোসেনের কাছে হেরে যাওয়া এম এ খালেক ও। দলের দুই প্রভাবশালী নেতার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এই নির্বাচনে দলের হাইকমান্ড মনোনয়নে কৌশলী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির আনকোরা প্রার্থী সাহিদুজ্জামান খোকনকে প্রথমবারের মত দেওয়া হয় নৌকার মনোনয়ন। খালেক-মকবুল এক হয়ে মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে দিনের পর দিন বিক্ষোভ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নৌকার মাঝি হিসেবে সাহিদুজ্জামান খোকনকেই বহাল রাখা হয়। দলের স্বার্থে খালেক, মকবুল কেউই বিদ্রোহী প্রার্থী হননি সেবার।
কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে এবং নিজ সাংগঠনিক দক্ষতায় নির্বাচনের শেষ মুহুর্তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হন খোকন। দীর্ঘ বছর পর গাংনীর আওয়ামী লীগ পরিবার ঐক্যবদ্ধ হয়। ফলশ্রুতিতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবারের মত এই আসনে নৌকার মাঝি হিসেবে বিজয় ছিনিয়ে আনেন সাহিদুজ্জামান খোকন। এমপি নির্বাচিত হয়ে বহু সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষের নজর কাড়েন তিনি। গাংনীর উন্নয়নে সংসদে তার কণ্ঠ ছিল সবসময় উচ্চকিত। তবে নির্বাচনের পর থেকে এমপি খোকনের সাথে খালেক-মকবুল এর টানাপোড়েন চলতে থাকে। মকবুল হোসেন এবং এম এ খালেকের অনুসারীরা এমপি সাহিদুজ্জামান খোকনকে স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং সংসদ সদস্য পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে থাকে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ খালেক অবশ্য মাঝে মাঝে এমপি খোকন এবং সাবেক এমপি মকবুল হোসেনের সাথে দলীয় এবং সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকেন। দলের স্বার্থে এবং নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে তিনি কিছুটা ব্যালেন্স করে চলেন উভয় গ্রুপের সাথে। মনোনয়ন পেয়ে যেমনিভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিলেন সফলভাবে, তেমনিভাবে এমপি নির্বাচিত হয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেননি এমপি খোকন। তবে এমপির ব্যর্থতা না কি বিরোধী পক্ষের অসহযোগিতার কারনে এই প্রশ্ন রয়েই যায়।
গত বছর গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে এমপি খোকনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন সভাপতি প্রার্থী হন। কাউন্সিলরদের সবাই সভাপতি পদে সাহিদুজ্জামান খোকনের প্রতি তাদের জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেন। ১৮ বছর পরে বহুল আকাঙ্খিত জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলনে সাহিদুজ্জামান খোকন দ্বিতীয় মেয়াদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোনীত হন। হতাশ হন খোকন বিরোধীরা। সাংবাদিক সম্মেলন করে নবনির্বাচিত কমিটির সভাপতি সাধারন সম্পাদকের মেয়াদ সপ্তাহ না পেরোতেই কমিটি বাতিলের দাবি সহ সভাপতি সাধারন সম্পাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তাদের দাবি এমপি খোকন যখন ২০০৪ সালের কাউন্সিলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তখন তিনি এ ধরনের দাবি করেন নি। এমনকি কেউ কেউ দাবি করেন ঐ সম্মেলনে মকবুল হোসেন সাহিদুজ্জামান খোকনকেই সমর্থন দেন। যুদ্ধাপরাধীর সন্তান হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন তখন কেন প্রতিবাদ করেন নি, তখন কেন তাকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছিলেন? কাজেই ১৮ বছর পরে এসে তাদের এসব দাবি কেবল অযৌক্তিক- ই নয় হাস্যকর ও বটে। তবে খোকন বিরোধীদের দাবি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এসব কমিটি পকেট কমিটি এবং কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক সকলেই খোকনের অনুগত।
মকবুল হোসেন এবং এম এ খালেক যেমন দলের দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত নেতা, তেমনি উপজেলা আওয়ামী লীগের পুনরায় নির্বাচিত সভাপতি সাংসদ সাহিদুজ্জামান খোকন এবং নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মখলেছুর রহমান মুকুল ও আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথের পরীক্ষায় বারবার উত্তীর্ণ। আবার খোকন-মুকুলের বিরোধী পক্ষে অবস্থান নেওয়া পৌর মেয়র আহমেদ আলী, ওয়াসিম সাজ্জাদ লিখন, শফি কামাল পলাশ, মোশাররফ হোসেন, মজিরুল ইসলাম এবং ইসমাইল হোসেন ও দলের দুঃসময়ে দল ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের প্রত্যেকেরই দলের দুঃসময়ে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে ওয়াসিম সাজ্জাদ লিখন ছিলেন নব্বইয়ের দশকে গাংনী-মেহেরপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দক্ষ ছাত্রনেতা। আবার বিএনপির ২০০১-২০০৬ মেয়াদে সরকার বিরোধী আন্দোলনে পৌর মেয়র আহমেদ আলীর সাহসী ভূমিকার কারনে তাকে অনেকেই গাংনীর লৌহ মানব হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ৯০ দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা শফি কামাল পলাশের ও দলের দুঃসময়ে সাহসি ভূমিকার কথা সকলের জানা। প্রত্যেকেই এই দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সুতরাং দলের স্বার্থে সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরী। অথচ সম্মেলনের ন্যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কে কেন্দ্র করে আবারো বিভিন্ন বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতারা। কর্মীরা ও দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন।
মকবুল-খোকন-খালেক ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের কারণে ২০১৮ সালের মত এবারো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড এমপি প্রার্থী হিসেবে নতুন একজন কে বেছে নিয়েছেন। আগামী ৭ জানুয়ারি হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডাক্তার আবু সালেহ মোঃ নাজমুল হক সাগর। ডাক্তার সাগর নব্বইয়ের দশকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী এবং পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সাগরের জন্ম ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ পরিবারে। ডাক্তার সাগরের প্রয়াত পিতা নূরুল হক ছিলেন গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নূরুল হক সত্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন জনতার বিপুল ভোটে। তিনি আমৃত্যু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। গাংনী আওয়ামী লীগের শক্ত ভিত গড়ে উঠেছিলো তার হাত ধরেই। সাগরের বোন সেলিনা আক্তার বানু দশম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ছিলেন। সাগর কে দলের প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও বর্তমান এমপি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ সাহিদুজ্জামান খোকন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ খালেকের উপস্থিতিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মখলেছুর রহমান মুকুল কে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সাংসদ সাহিদুজ্জামান খোকন নিজেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। এম এ খালেক দলের কাছে মনোনয়ন চাইলেও দল মনোনয়ন না দেওয়ায় তিনি প্রার্থী হননি। গাংনীর রাজনীতিতে এম এ খালেক এবং এ্যাডভোকেট এ. কে. এম. শফিকুল আলম ব্যতিক্রম যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কখনো নির্বাচন করেননি দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে। মনোনয়ন না পেলে প্রথম থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ইচ্ছুক মকবুল হোসেন ও মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন।
দলের চার হেভিওয়েট প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষেই স্ব স্ব বলয়ের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন। দলের মনোনীত প্রার্থী সাগরের পক্ষে পৌর মেয়র আহমেদ আলী এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এ. কে. এম. শফিকুল আলম সহ বিভিন্ন ইউনিয়নের দলীয় চেয়ারম্যান এবং উপজেলা ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃবৃন্দ অবস্থান নিয়েছেন। সাবেক এমপি মকবুল হোসেনের পক্ষে উপজেলা যুবলীগ এবং বর্তমানে পদ-পদবিহীন দলের সাবেক অনেক নেতা শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের একাংশ বর্তমান এমপি সাহিদুজ্জামান খোকনের পক্ষে এবং আরেক অংশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মখলেছুর রহমান মুকুলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক সহ অনেকেই এখনো অনেকটাই চুপচাপ রয়েছেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
দল করলে এভাবে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত কিংবা নির্দেশনার বাইরে যাওয়া কিংবা নিরব থাকার কোনো সুযোগ আছে কি? সবারই মনে রাখা উচিত আওয়ামী লীগে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই অপরিহার্য নয়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, ৬০’র দশকের তুখোড় নেত্রী আমেনা বেগম, ডক্টর কামাল হোসেন, মোস্তফা মহসীন মন্টু, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডাকসুর সাবেক জনপ্রিয় ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ৯০ ও ৯৬ এর গণআন্দোলনের অন্যতম রুপকার হাবীবুর রহমান হাবীব সহ অসংখ্য নেতা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে, নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী সকল ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক মানুষকে যেমন আওয়ামী লীগ করার অধিকার দলের প্রস্তাবনা ও গঠনতন্ত্রে দেওয়া হয়েছে, তেমনি দলের সিদ্ধান্ত মানাও সকলের জন্য অপরিহার্য। যেসব নেতা তাদের জনপ্রিয়তা কে পুঁজি করে মনে করেন তারা যা ইচ্ছে করতে পারেন কিংবা যারা মনে করেন একমাত্র তারাই আওয়ামী লীগ করতে পারবেন, অন্য কেউ নয় তারা দলের জন্য শক্তি নন বরং অভিশাপস্বরুপ। ব্যক্তিস্বার্থে নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি না করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে সকল বিভেদ, গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব ভুলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র রুঁখে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জনগণের সমর্থনে টানা চতুর্থবারের মত ক্ষমতায় আনতে এর কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প কিছু ভাবলে আওয়ামী লীগ করার অধিকার থাকবেনা। আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। অন্যথায় ভাসানী, তর্কবাগীশ, আমেনা, কামাল, মন্টু, মনসুর, হাবীবদের পরিণতি ভোগ করতে হবে। কারো জন্যই এই পরিণতি কাম্য নয়। বরং বিভেদহীন, ঐক্যবদ্ধ গাংনীর আওয়ামী লীগ পরিবারই আমাদের কাম্য। কিন্তু আদৌ কি আসবে সেই দিন? অবসান হবে কি অপেক্ষার?
লেখক- মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা, খুলনা মহানগর, গাংনীর সন্তান।