ব্যভিচার ও ধর্ষণ সম্পর্কে ইসলামের বিধান

গাংনীর চোখগাংনীর চোখ
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  11:32 AM, 09 October 2020

নারী ও শিশু ধর্ষণ বাংলাদেশে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে নারী ও শিশু ধর্ষণের জগন্যতম ঘটনা। দেশের কোথাও ধর্ষক নামের নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী ও শিশুরা। দেশে প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা। অপ্রতিরোধ্য নারী ও শিশু ধর্ষণের রাস টানতে ইতোমধ্যে সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদÐ পর্যন্ত করে আইন করেছে।

শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে মোট ৪৯৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৩৫১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে এ দুই মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২১৪ শিশু। বাকি চার মাসে ধর্ষণের শিকার হয় ২৮২টি শিশু। প্রতি মাসের গড় হিসেব করলে প্রায় ৮৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৫৭১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে শতকরা ৪১ শতাংশ যা অত্যন্ত আশংকাজনক। এই বছরের প্রথম ৬ মাসে ধর্ষণ হওয়া এই ৪৯৬টি শিশুর মধ্যে ৫৩ জন শিশুকে গণধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৭টি প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৩ জন শিশুকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও এই ৬ মাসে ৭৪টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ বছর শিশু ধর্ষণের ঘটনা অতিতের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। শিশু অধিকার ফোরামের মতে, সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। তাই এই সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই মনে করে সংস্থাটি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়া বেশিরভাগ শিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা বেশি হন যৌন নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে পুরুষ শিক্ষকের হাতে এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেশিঘটে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১২৯ জন। এদের মধ্যে ১৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

একইসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, বছরের প্রথম ছয় মাসেই সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন নারী ও শিশু। যাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। গতবছর সারাদেশে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় ৬৩ জন নারী ও শিশুকে। অর্থাৎ, গতবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছে তার অর্ধেক সময়ে এবছর ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ।
সুত্র দৈনিক ইনকিলাব
: ২৫ জুলাই, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ধর্ষন ও অন্যান্য অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কয়েকটি কারণ:-
১: ধর্মীয় ও পারিবারিক শিক্ষার অভাব।
২:সমাজে ভালো মানুষেকে মুল্যায়ন না করা।
৩:নারি দেহকে অবাধ ও অশ্লীল ভাবে প্রদর্শন।
ও বিভিন্ন সিনেমাতে ধর্ষণের চিত্র দেখানো।
৪:নারির নিরাপত্তার অভাব
৫:সমাজে বিবাহকে কঠিন, এবং বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে সহজ করা।
৬:সমাজে কার্যকর ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি না থাকা

★ব্যভিচার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন
,وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّہٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَ سَآءَ سَبِیۡلًا ﴿۳۲﴾
‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হইও না। এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩২), প্রখ্যাত তাফসিরবিশারদ ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, “উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ‘ব্যভিচার করো না’-এর চেয়ে ‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’ এটি অনেক বেশি কঠোর কথা।” এর সহজ অর্থ হলো, যেসব বিষয় ব্যভিচারে উদ্বুদ্ধ করে ও ভূমিকা রাখে সেগুলোও হারাম।

★রাসুল {স}এর কাছে ব্যভিচারের অনুমতি চাওয়া
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, একজন যুবক রাসূলুল্লাহর (সঃ) কাছে। ব্যভিচারের অনুমতি প্রার্থনা করে। জনগণ প্রতিবাদ করে বলেঃ “চুপ কর, কি বলছো?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলেনঃ “বসে যাও।” সে বসে গেলে তিনি তাকে বলেনঃ তুমি এই কাজ কি তোমার মায়ের জন্যে পছন্দ কর?” উত্তরে সে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ আমাকে আপনার উপর উৎসর্গ করুন! আল্লাহর কসম! আমি কখনো এটা পছন্দ করি না।” তখন তিনি তাকে বললেনঃ “তাহলে অন্য কেউ এটাকে কি করে পছন্দ করতে পারে?” এরপর তিনি তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, এই কাজটি তুমি। তোমার মেয়ের জন্যে পছন্দ কর কি?” লোকটি চরমভাবে এটাও অস্বীকার করলো। তিনি বললেনঃ “ঠিক এরূপই অন্য কেউই এটা তার মেয়ের জন্যে পছন্দ করে না। তারপর তিনি বললেনঃ “তুমি তোমার বোনের জন্যে এটা পছন্দ করবে কি?” অনুরূপভাবে সে এটাকেও অস্বীকার করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এইরূপ অন্যেরাও তাদের বোনদের জন্যে এটাকে অপছন্দ করবে।” অতঃপর তিনি বললেনঃ “কেউ তোমার ফুফুর সাথে এই কাজ করুক এটা তুমি পছন্দ কর কি?” সে এটাকেও কঠিনভাবে অস্বীকার করলো। তিনি বললেনঃ “অনুরূপ ভাবে অন্যেরাও এটা পছন্দ করবে না।” এরপর তিনি। বলেনঃ “তোমার খালার জন্যে এ কাজ তুমি পছন্দ কর কি?” উত্তরে সে বলেঃ “কখনই নয়।” তিনি বললেনঃ “এইরূপ সবাই এটা অপছন্দ করে।” অতঃপর তিনি স্বীয় হস্ত মুবারক তার মস্তকের উপর স্থাপন করে দুআ করলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি এর পাপ মার্জনা করুন! এর অন্তর পবিত্র করে দিন এবং একে অপবিত্রতা হতে বাঁচিয়ে নিন!” অতঃপর তার অবস্থা এমন হলো যে, সে কোন মহিলার দিকে দৃষ্টিপাতও করতো না।

★ব্যভিচারীর পরিণাম
হাদিসে এসেছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখিরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো ১. চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া, ২. দরিদ্রতা, ৩. অকালমৃত্যু। আর আখিরাতের তিনটি হলো ১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ২. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা ও ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই. ফা. পৃষ্ঠা : ১০৯)

ব্যভিচারে অভ্যস্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে ঈমান ও আমল থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মানুষ যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং এটি তার মাথার ওপর মেঘখণ্ডের মতো ভাসতে থাকে। অতঃপর সে যখন তাওবা করে, তখন ঈমান আবার তার কাছে ফিরে আসে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৯০)

তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ব্যভিচার করে বা শরাব পান করে, আল্লাহ তার ওপর থেকে ঈমান ছিনিয়ে নিয়ে যান, যেভাবে মানুষ মাথার দিক দিয়ে জামা খুলে নেয়।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম : ১/২২)

اَفَاَمِنَ الَّذِیۡنَ مَکَرُوا السَّیِّاٰتِ اَنۡ یَّخۡسِفَ اللّٰہُ بِہِمُ الۡاَرۡضَ اَوۡ یَاۡتِیَہُمُ الۡعَذَابُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿ۙ۴۵﴾
اَوۡ یَاۡخُذَہُمۡ فِیۡ تَقَلُّبِہِمۡ فَمَا ہُمۡ بِمُعۡجِزِیۡنَ ﴿ۙ۴۶﴾

অর্থ:দুনিয়ায় বিভিন্ন কারণে মানুষ পাপ করে পার পেয়ে যায়। পরকালে অবশ্যই এর শাস্তি ভোগ করতে হবে; এমনকি দুনিয়ায়ও যেকোনো সময় পাপী ব্যক্তি আল্লাহর আজাবে পতিত হতে পারে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা পাপাচারের ষড়যন্ত্র করে, তারা কি এ বিষয়ে নির্ভয় হয়ে গেছে যে আল্লাহ তাদের ভূগর্ভে বিলীন করবেন না অথবা এমন দিক থেকে আজাব আসবে না, যা তাদের ধারণাতীত? অথবা চলাফেরারত অবস্থায় তিনি তাদের পাকড়াও করবেন না? তারা তো তা ব্যর্থ করতে পারবে না।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৫-৪৬)

★ব্যভিচারের শাস্তি
অবিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি ব্যভিচারী যদি অবিবাহিত হয় তবে তাদের প্রকাশ্য বিচারালয়ে ১০০ বেত্রাঘাত করা। বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তিব্যভিচারী যদি বিবাহিত হয়, তবে তাদের প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করা।
-আল্লাহ বলেন,
اَلزَّانِیَۃُ وَ الزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّ لَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَ لۡیَشۡہَدۡ عَذَابَہُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲﴾

‘ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী উভয়কে একশ’ ঘা করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকরী করবে এদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের অভিভূত না করে। যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাক। ঈমানদারদের একটি দল যেন এদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সুরা নুর : আয়াত ২)
★হাদিস
হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমার কথা গ্রহণ কর, তোমরা আমার কথা গ্রহণ কর! আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্যে পন্থা বের করে দিয়েছেন। অবিবাহিত পুরুষ ও অবিবাহিতা নারী ব্যভিচার করলে একশ’ চাবুক ও এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ ও বিবাহিতা নারী ব্যভিচার করলে রজম।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আরবাআ ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

বেত্রাঘাতের সময় হদ বাস্তবায়নকারীর অন্তরে কোনো মায়া বা ভালোবাসা পোষণ করা যাবে না।
বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে তার কি শাস্তি হবে তা কুরআন এবং হাদিসে সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে।
এখানে ব্যভিচারের শাস্তির দুটি হাদিস তুলে ধরা হলো

হাদিসে এসেছে- একবার বনি আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তি হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এসে বলল, আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছি। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাস করলেন, তুমি এ কথা আর কাউকে বলেছ? সে উত্তর দিল না। তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি আল্লাহর কাছে মাফ চাও এবং গোপনীয়তা রক্ষা কর। আল্লাহ তোমার দোষ গোপন রাখবেন এবং তোমার তাওবা কবুল করবেন। এ কথায় আশ্বস্ত না হয়ে সে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিকট গেলেন এবং পূর্বের মতো বললেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে আবু রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো বললেন। কিন্তু সে কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারল না।অগ্যতা সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল আমার দ্বারা ব্যভিচার সংঘটিত হয়েছে। রাসুল মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যখন সে তার কথা ওপর জিদ ধরে রইল, তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরিবারের লোকদের ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‌এ কি পাগল? এখনও কি পাগলামি করছে? তারা উত্তর দিল না, হে আল্লাহর রাসুল!, সে সম্পূর্ণ সুস্থ।রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‌তুমি কি বিবাহত না অবিবাহিত? সে উত্তর দিল, আমি বিবাহিত। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড (রজম) দিলেন।’ (মুয়াত্তা)

এক মহিলা সাহাবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল, আমি জিনা (ব্যভিচার) করেছি। জিনার কারণে গর্ভবর্তী হয়েছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি চলে যাও। সন্তান হলে এবং তার দুধ পান করানোর সময় অতিবাহিত হলে এসো। যখন তার সন্তানের দুধ পানের মেয়াদ শেষ হলো, তখন সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে উপস্থিত হলো। তিনি বললেন, তোমার এ সন্তানকে কারো দায়িত্বে দিয়ে দাও। যখন সে সন্তানকে অন্য একজনের দায়িত্বে রেখে এলো। তখন তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যার নির্দেশ দেয়া হলো। তার জন্য বুক সমান গভীর এক গর্ত খুঁড়া হলো এবং তাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হলো। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জানাজার নামাজ পড়ালেন।হজরত ওমর আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তার জানাজা নামাজ পড়ালেন? এতো ব্যভিচারিনী। তিনি বললেন, এ মহিলা এমন তাওবা করেছে তা যদি পৃথিবীবাসীর মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয় তবে তা সবার জন্য যথেষ্ট হবে। এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে যে, সে (আল্লাহর ভয়ে) নিজের জীবন দিয়ে দিল। (মুয়াত্তা)
নাসাঈ’র হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে পাথর নিক্ষেপ করতে আসলেন এবং তাকে লক্ষ্য করে সজোরে একটি পাথর নিক্ষেপ করলেন। তখন তিনি গাধার ওপর সওয়ার ছিলেন।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) ও হযরত যায়েদ ইবনে খালিদ জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, দু’জন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করে। একজন বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার ছেলে এ লোকটির বাড়ীতে মজুর ছিল। সে এর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করে ফেলেছে। আমি তার মুক্তিপণ হিসেবে একশটি বকরী ও একটি দাসী একে প্রদান করি। অতঃপর আমি আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি যে, আমার ছেলের উপর শরঈ শাস্তি হলো একশ’ বেত্রাঘাত ও এক বছরকাল দেশান্তরকরণ। আর এর স্ত্রীর শাস্তি হলো রজম বা প্রস্তরাঘাতে হত্যা।” তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “জেনে রেখো যে, আমি তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সঠিক ফায়সালা করছি। একশ’ বকরী ও দাসী তুমি ফিরিয়ে পাবে এবং তোমার ছেলের উপর একশ’ বেত্রাঘাত ও এক বছরকাল দেশান্তর।” আর আসলাম গোত্রের। উনায়েস নামক একটি লোককে তিনি বললেনঃ “হে উনায়েস! সকালে তুমি এই লোকটির স্ত্রীর নিকট গমন করো। যদি সে ব্যভিচারের কথা স্বীকার করে নেয় তবে তুমি তাকে রজম করবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কথামত উনায়েস সকালে ঐ স্ত্রী লোকটির নিকট গমন করলো এবং সে ব্যভিচারের কথা স্বীকার করে নেয়ায় তাকে রজম করে দিলো। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)

★ইসলামে ধর্ষণ প্রমাণের নীতিমালা
ব্যভিচার প্রমাণের জন্য ইসলামে দু’টোর যে কোনোটি জরুরি। ক. ৪ জন সাক্ষী, খ. ধর্ষকের স্বীকারোক্তি।

তবে সাক্ষী না পাওয়া গেলে আধুনিক ডিএনএ টেস্ট, সিসি ক্যামেরা, মোবাইল ভিডিও, ধর্ষিতার বক্তব্য ইত্যাদি অনুযায়ী ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার করে স্বীকার করার জন্য চাপ দেওয়া হবে। স্বীকারোক্তি পেলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করা হবে।

★ধর্ষণের শাস্তি
> ইমাম আবু হানিফা, শাফেঈ ও আহমদ ইবনে হাম্বাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম-এর মত হলো- ‘ধর্ষণের জন্য ব্যভিচারের শাস্তি প্রযোজ্য হবে।’ অর্থাৎ ধর্ষক অবিবাহিত হলে ১০০ বেত্রাঘাত আর বিবাহিত হলে পাথর মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করা।

>> ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহির মত- ‘ধর্ষণের অপরাধে ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগের পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তিও প্রয়োগ করতে হবে।

মুহারাবা কি?‘মুহারাবা’ হলো অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা কিংবা লুণ্ঠন করা। এক কথায় ‘মুহারাবা’ হলো পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, লুণ্ঠন, নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ইত্যাদি। এ সব অপরাধের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ ঘোষণা করেন-
اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیۡنَ یُحَارِبُوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ یَسۡعَوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَسَادًا اَنۡ یُّقَتَّلُوۡۤا اَوۡ یُصَلَّبُوۡۤا اَوۡ تُقَطَّعَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ اَرۡجُلُہُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ اَوۡ یُنۡفَوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ ؕ ذٰلِکَ لَہُمۡ خِزۡیٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿ۙ۳۳﴾

‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে->> তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা>> শূলীতে চড়ানো হবে অথবা>> তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে (ডান হাত বাম পা/বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা>> দেশ থেকে বহিষ্কার তথা নির্বাসিত করা হবে।এটি হল তাদের জন্য দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৩৩)
আর যদি ধর্ষণ কারণে হত্যাজনিত অপরাধ সংঘটিত হয় কিংবা ধর্ষণের শিকার কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তবে ঘাতকের একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।

ইসলামের প্রথম যুগের জোরপূর্বক ব্যভিচার তথা ধর্ষণের কিছু বিচারের বর্ণনা->>

হজরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের (কোরআন-হাদিসে বহু অপরাধের ওপর শাস্তির কথা আছে। এগুলোর মধ্যে যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত তাকে- হদ বলে) শাস্তি দেন। ’ -ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮

>> হজরত নাফি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, ‘(হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে) এক ব্যক্তি এক কুমারী মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। লোকজন ধর্ষণকারীকে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে উপস্থিত করলে সে (ধর্ষক) ব্যভিচারের কথা অকপটে স্বীকার করে। লোকটি ছিল অবিবাহিত। তাই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নির্দেশ মোতাবেক লোকটিকে বেত্রাঘাত করা হলো। এরপর তাকে মদিনা থেকে ফাদাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।’ (মুয়াত্তা মালিক)

>> হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে সরকারি মালিকানাধীন (কাজে নিযুক্ত) এক গোলাম এক দাসির সঙ্গে জবরদস্তি করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে ওই দাসির কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ওই গোলামকে কষাঘাত (বেত্রাঘাত) করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিকে কোনো শাস্তি প্রদান করেননি।’ (বুখারি ৬৯৪৯)

ইসলামে ধর্ষণের কারণে মৃত্যু হলে সে প্রথমে ব্যভিচারের শাস্তি পাবে। পরে হত্যার শাস্তি পাবে। হত্যা যদি অস্ত্র দিয়ে হয় তাহলে কেসাস বা মৃত্যুদণ্ড। আর যদি অস্ত্র দিয়ে না হয়, এমন কিছু দিয়ে হয়- যা দিয়ে সাধারণত হত্যা করা যায় না। তাহলে অর্থদণ্ড। যার পরিমাণ একশ’ উটের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ (প্রায় কোটি টাকা)।

ধর্ষণের সঙ্গে যদি আরও কিছু সংশ্লিষ্ট হয়- যেমন ভিডিওধারণ, ওই ভিডিও প্রচার ইত্যাদি; তাহলে আরও শাস্তি যুক্ত হবে।

সাইদ ইবনে জায়েদ (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। দীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৭২, তিরমিজি, হাদিস : ১৪২১)

★ধর্ষিতা অপরাধী নই
ইসলামি আইনবিদরা একমত হয়েছেন যে, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে ধর্ষণের কারণে অভিযুক্ত করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তার কোনো পাপ নেই। কেননা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ ও বলপ্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪৫)
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে হেফাজত করুন।আমিন।

 

তথ্য ও ছবিঃএইচ কে এম মুসতাক আহমে

আপনার মতামত লিখুন :