নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও একবার মিলন করে?
মৌমাছি খুবই শান্তিপ্রিয় প্রাণী। বিনা কারণে এরা কাউকে আক্রমণ করে না। কিন্তু অস্তিত্বের প্রশ্নে কোন ছাড় নেই!এরা তখন এদের সমরাস্ত্র হুল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মৌমাছির সবচেয়ে আকর্ষনীয় গুন হলো মৌমাছির নাচ, যাকে বলা হয় Waggle Dance… তবে এই নাচ শুধুই নাচ নয়। এই নাচের মাধ্যমে মৌমাছিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। মৌমাছির রয়েছে এক অসাধারণ বিজ্ঞান ও দূরত্ব মাপার কৌশল।
খাবার খোজার জন্য প্রথমে অল্প কিছু মৌমাছি চারিদিকে উড়ে যায়। কিছু সংখ্যক মৌমাছি যখন কোন ফুলে পরাগরেণুর সন্ধান জানতে পায়, তখন সে অন্য সবাইকে জানানোর জন্য চাকে ফিরে যায়, ফিরে গিয়ে একটা অদ্ভুত নাচ নাচে যার মাধ্যমে অন্য মৌমাছি মধু সংগ্রহের নির্দেশনা ও অবস্থান পায়।
এই নাচের মাধ্যমে শুধু সন্ধানই দেয় না, এর পাশাপাশি অবস্থান ও দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। মৌমাছি এক আশ্চর্য গনিতবিদের ন্যায় সূর্যের অবস্থানের সাথে ফুলটি কত ডিগ্রি কোণে কতটুকু দূরত্বে অবস্থান করছে তা নির্দেশ করে। এই ক্ষেত্রে মৌমাছি সূর্যকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে। আবার যখন মেঘলা থাকে এবং সূর্য মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়, তখন এরা এদের বিশেষ ফটোরিসেপ্টর ব্যবহার করে পোলারাইজড আলো ব্যবহার করে সূর্যের সঠিক অবস্থান বের করে ফেলে।
কার্ল ফন ফ্রিশ নামে এক অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী গত শতকের চল্লিশের দশকে এটা আবিষ্কার করেন এবং এই কাজের জন্য ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান! আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে মৌামাছির প্রতিটি কোটর দেখতে ষড়ভুজাকার কেন???মৌমাছির লক্ষ হলো সর্বাধিক মধু সংগ্রহ করা। মধু রাখার জন্য মোম দিয়ে ঘর বানাতে হবে। তাই তাদের এমন একটি উপায় বেছে নিতে হবে যেন এই ঘর তৈরিতে কোন স্থানের অপচয় না হয় এবং ঘরের আয়তন সর্বাধিক হয়। ঘর তৈরিতে প্রথমে মাথায় আসে গোলাকৃতির কিন্তু গোলাকৃতির ঘর বানালে কয়েকটি ঘরের মাঝে স্থানের অপচয় বেশি হয়। আবার ত্রিভুজাকার বা বর্গাকার ঘর তৈরি করলে স্থানের অপচয় না হলেও দেয়াল তৈরিতে মোম বেশি লাগে। মোম বেশি তৈরি করতে গেলে মধুর উৎপাদন কম হয়। সবদিক চিন্তা করে দেখা যায় ষড়ভুজাকৃতির ঘরে অল্প দেয়ালে সর্বোচ্চ স্থানের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আল্লাহর শুকরিয়া, কত জ্ঞান দিয়ে তাদের দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে আমাদের খাবার তৈরি করতে!মৌমাছির বেগ ঘন্টায় ১৫ মাইল এবং এরা ৬ মাইল পর্যন্ত উড়তে সক্ষম। এদের ডানা ঝাপটানোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ২২০ বার।
এজন্য এদের গুনগুনানি অনেক দূর থেকে শোনা যায়। মৌমাছিই একমাত্র পোকা যা সরাসরি মানুষের খাদ্য তৈরি করে। একেকটা মৌচাকে প্রায় ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মৌমাছি থাকে। মৌচাকে মোট ৩ ধরণের মৌমাছি থাকে। কর্মী মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি এবং রাণী মৌমাছি। শুধু কর্মী মৌমাছিই চাক বানানো ও মধু সংগ্রহের কাজ করে। শুধুমাত্র কর্মী মৌমাছির ই হুল থাকে। এরাই চাকের বাইরে ঘুরে বেড়ায়।
মৌমাছির হুল তার জীবনের একবারই ব্যবহার করতে পারে। হুল ফুটানোর পর সেই মৌমাছির মৃত্যু ঘটে!তবে এরা মৃত্যুর জন্য মোটেও ভয় পায় না। একজন মানুষকে মারতে হলে প্রায় ১১০০ হুলের বিষ প্রয়োজন। আনুমানিক ১ কেজি মধু সংগ্রহের জন্য ১১০০ মৌমাছি প্রায় ৯০ হাজার মাইল পথ ঘুরতে হয়। যা কিনা চাদের কক্ষপথের প্রায় তিনগুণ!ফুলের হিসাব করলে দেখা যায় ১ কেজি মধু সংগ্রহের জন্য প্রায় ৪০ লক্ষ ফুলের পরাগরেণু স্পর্শ করতে হয়।
সবকিছু ঠিক থাকলে ভালো মৌসুমে প্রায় ৫৫ কেজি মধু জমা হয়। এসব তথ্য থেকে আমরা বুঝতে পারি কর্মী মৌমাছি কি পরিমাণ পরিশ্রমী। অপরদিকে রাণী মৌমাছি শুধু খায় আর ডিম পারে!রাণী প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২৫০০ ডিম দেয়। পুরুষ মৌমাছির স্বভার বেশ অদ্ভুত। এরা জীবনেও কোন কাজ করে না, এমনকি কর্মী মৌমাছিকে এদের খাবার পর্যন্ত মুখে তুলে দিতে হয়।
এদের জীবনের একমাত্র লক্ষ হলো রাণী মৌমাছির সাথে মিলিত হওয়া!মিলন মৌসুমে প্রতিদিন দুপুরবেলা চাকের সর্বাধিক সক্ষম পুরুষ মৌমাছিগুলো একটি নির্দিষ্ট স্থানে ভিড় জমায় যাকে বলা হয় পুরুষ ধর্মসভা!ঠিক একই সময়ে চাক থেকে রাণী মৌমাছি ঘুরতে বের হয়, যাকে বলা হয় “দি মিটিং ফ্লাইট”রাণী মৌমাছি হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে পুরুষ ধর্মসভা এলাকায়। সে এসেই এক বিশেষ ধরণের গন্ধ ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে শত শত পুরুষ মৌমাছি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এর পরপরই রাণী মৌমাছি উড়ন্ত অবস্থায় পছন্দমত পুরুষের সাথে মিলন করে।
রাণী মৌমাছি একেবারে পর্যায়ক্রমে ১৮-২০টা পুরুষ মৌমাছির সাথে মিলিত হতে পারে!অদ্ভুত ব্যাপার হল, যৌন মিলনের সময় পুরুষ মৌমাছির এন্ডোফেরাস বা যৌনাঙ্গ ভেঙ্গে যায় এবং তখনই মারা যায় পুরুষ মৌমাছি। এজন্যই এই মিলনকে বলা হয় “দি ড্রামাটিক সেক্সুয়াল সুইসাইড”অনাকাঙ্খিতভাবে যদি কোন রাণী মৌমাছি মারা যায় তবে সে খবর ১৫ মিনিটের মধ্যে সকল কর্মী মৌমাছি জানতে পারে এবং সম্মিলিতভাবে নতুন রাণী মৌমাছি তৈরি করার উদ্যোগ নেয়। আরো কিছু অদ্ভুত বিষয় রয়েছে, যা জানলে আপনারা অবশ্যই অবাক হবেন,,, ৫০০ গ্রাম মধু তৈরিতে ২০ লক্ষ ফুল লাগে। শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছি সারা জীবনে আধা চা চামচ মধু তৈরি করতে পারে। আরো একটা মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে মধু একমাত্র খাদ্য যা কখনোই পঁচে না!!!