নাগরিকত্ব চান ব্রিটিশ নাগরিক রোজ
মেহেরপুরে ব্রিটিশ নাগরিক জিলিয়ান এম রোজ প্রত্যন্ত জনপদে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে চলেছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশে আছেন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর মিশনারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবিকা।
বয়সের ভারে চলার শক্তি অনেকটা কমে গেলেও দমে যাননি তিনি। মানুষের মাঝেই বেঁচে থাকতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়া রোজ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে চান। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠন তাকে সম্মাননা ও এদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও আজো তা আলোর মুখ দেখেনি। অনেকটা হতাশও এই মহিয়শী নারী।
রোজের ভাষ্যে- ১৯৬৪ সালে তিনি বরিশাল এসেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের মানুষ, মাটি, প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাংলাদেশে অবস্থানকালীন কাজের ফাঁকে ইচ্ছেমতো ঘুরেছিলেন এখানে-ওখানে। পরে ১৯৭০ সালে মা, মাটি ও স্বজনদের টানে নিজ দেশে ফিরে যান। কিন্তু এ দেশের মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৭৪ সালে ফের চলে আসেন। দেশে নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমে খুলনা এবং পরে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর হাসপাতালে আসেন। মানুষের সেবা দিতে গিয়ে আর সংসার করা হয়নি।
এ চিরকুমারী ৫৮ বছর ধরে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে চিকিৎসা সেবা দিয়ে চলেছেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে কথা না বললেও নিজ হাতে রোগীকে সেবা দিয়ে চলেন নিরলসভাবে। দীর্ঘদিন ধরে চলছে লাল সবুজের এ দেশের সঙ্গে তার হৃদয়ের মিতালী। তার হৃদয়জুড়ে এখন বাংলাদেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। অন্য দেশের নাগরিক হয়েও এ দেশের মানুষকে পরম মমতা ও যত্নে সেবা দিয়ে জেলার মানুষের মন জয় করেছেন। এলাকার মানুষের প্রিয়জন নিভৃতচারী জিলিয়ান এম রোজ। চলনে-বলনে বর্তমানে বাঙালিয়ানা জিলিয়ানের এখন একটি-ই চাওয়া বাংলার মাটিতে শেষ বিদায়। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারায় বেশ খুশি জিলিয়ান। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন সেবা দিয়ে যাবেন। এছাড়া তিনি নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন বৃদ্ধাশ্রম। অনেক অপেক্ষার পর কিছুটা সময় দিলেন জিলিয়ান।
জিলিয়ান এম রোজ বলেন, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে স্বজনদের চাপাচাপিতে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষ ও মাটির ভালোবাসায় আর যেতে মন চায়নি। তার পরিবার তাকে একাধিকবার দেশে ফিরে যাওয়ার কথা জানালেও তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। জিলিয়ান জানান, সরকার যদি তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়, তাহলে তার সম্মান বাড়বে। তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এভাবে সেবা দিয়ে যাবেন।
বল্লভপুর মিশন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, জিলিয়ান এম রোজ অবিরত কাজ করেই চলেছেন। হাসি মুখে রোহিদের সাখে কথা বলছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। কখনও রোগির সাখে কথা বলছেন, আবার কাজের ফাঁকে ওয়ার্ডে যাচ্ছেন রোগিদের খবর নিতে। আবার যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে।
বল্লভপুর মিশন হাসপাতালের সিনিয়র নার্স নীলসুরি সরিন জানান, রাত-দিন তিনি মানুষকে সেবা দেন। নিজের জন্য কোনো কিছুু করেন না তিনি। কোন অহংকার নেই। সাদাসিদে পোষাক পরেন। খাবারও নিরামিশ খান। তার কাছ থেকে মানুষ হয়ে ওঠার গুণাবলী কিছুটা অর্জন করতে পেরেছি। তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। তার শেষকৃত করতে পারলে জিবন সার্থক হবে। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাণীর পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন হাইকমিশনার বল্লভপুরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে ওবিই (অর্ডার অফ দ্য বিৃটিশ এম্পায়ার) উপাধি দিয়ে সম্মানীত করেন।
মিশনারীতে যারা কাজ করছেন তারা জানান, অনেকবার জেলাবাসি অনেকবার সম্মাননা দিয়েছেন। সেখানে বারবার নাগরিত্বর বিষয়টি উঠে আসলেও আজো কোন সুরাহা হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রি ফরহাদ হোসেনও নাগরিকত্বের বিষয়টি দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু কোন পথে এগুলে নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা হবে তা কেউ জানাতে পারছেন না। সেবা নিতে আসা রোগি সাধারণ ও প্রশিক্ষণে আসা শিক্ষার্থীরা জিলিয়ানের কাজে মুগ্ধ এবং তার নাগরিকত্ব প্রদানের জোর দাবী তুলেছেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য বাবুল মল্লিক বলেন, মেহেরপুর জেলার মানুষ জিলিয়ান এম রোজকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেবার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তিনি নিজেও জেলা প্রশাসনের কাছে ২০১৮ খ্রিষ্টাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করেছেন। কিন্তু আজও তাকে সেই সম্মান দেয়া হয়নি। দীর্ঘদিন অত্র এলাকায় সেবা দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন জিলিয়ান।
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খান বলেন, বাংলাদেশকে যে মানুষটি এতো ভালো বেসেছেন নিশ্চয়ই বাংলাদেশও তাকে ভালোবাসবে। আমরাও তাকে ভালোবাসী। বাংলাদেশের মানুষ মনে করি। জিলিয়ানের কাজে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। নাগরিকত্বর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।