ধর্ষণ ব্যাধির প্রতিরোধ ও প্রতিকার
বিকৃত যৌনতা বা ধর্ষণ এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধিতে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার মনুষ্যত্ববোধ। করোনাকালীন সময়ে কোয়ারেন্টাইনে থাকার ফলে এই প্রবণতা আরো বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরমুখীতা, কর্মহীনতা ও অলস মস্তিষ্কের ফলে সমাজে ধর্ষণকাণ্ড বাড়ছে। আর তাই এই ধর্ষণ নামের মনুষ্য সামাজিক ব্যাধিটির কারণ চিহ্নিত করে এর আশু প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া অতি জরুরি।
মানুষ কেন ধর্ষণ করে?
বৈবাহিক পরবর্তী বৈধ যৌনতা মানুষের জীবনের একটি অন্যতম অধিকার। তবে এই যৌনতাকে বিকৃত করে উপস্থাপনই হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার চেয়েও ক্ষমতার বিষয়টি বেশি সম্পর্কিত। আমি পুরুষ হিসেবে আমার ক্ষমতা আছে যেকোনো সময় যেকোনো নারী বা শিশুকে ভোগ করার। পুরুষত্ববাদী এই মনোভাব আবার নারীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও ধর্ষণের পথ বেছে নিচ্ছে পুরুষ।
ফরাসি নারীবাদী তাত্ত্বিক, সিমোন দ্য বোভোয়ার- এর মতে, পুরুষের কাছে সে একজন নারী। তার শরীর একটি সেক্স অবজেক্ট মাত্র, সে নারী। আর এ কারণেই ধর্ষণকারীর কাছ থেকে শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না, কারণ তার বয়স যাই হোক। তার শরীরে নারী অঙ্গ আছে। যৌনতার জন্য একজন পুরুষের একটি নারী অঙ্গ হলেই চলে। তার বয়স দেখা লাগে না, সম্পর্ক দেখা লাগে না, প্রেম দেখা লাগে না, সময় দেখা লাগে না, সমাজ বা বিবেক কিছুই লাগে না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদী লেখিকা-সুশান ব্রাউন মিলার তার বিখ্যাত বই ‘এ্যাগেইন্সট আওয়ার উইল; ম্যান উইমেন এ্যান্ড রেইপ’ বইয়ে লিখেছেন, নারীকে ধর্ষণ করার ধারণা সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মধ্যে দিয়েই জন্ম হয়েছে। নারীকে যখন থেকে সামাজিকভাবে সম্পত্তি ভাবা হলো-তখন তার একটি ভ্যালুস তৈরি হয় নিজের শরীরের কারণে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভার্জিনিটির মূল্য তৈরি করা হয়। এই ভার্জিনিটি দিয়ে অন্য গোত্রের ছেলেদের সঙ্গে বার্গেনিং করা হয়।
এছাড়া কর্মহীন জীবন, মাদকাসক্ত, পর্নোগ্রাফিতে মশগুল থাকা, সামাজিক অবক্ষয় বা মূল্যবোধের অভাবেই মূলত ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয়ের এক পর্যায়ে বিচার-বিশ্লেষণ না করে মেলামেশাও ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কারা ধর্ষিত হচ্ছে?
জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পোশাক শ্রমিকরা রাত-বিরাতে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে হয়। এ সময়ও ঘটছে অনাকাঙ্খিত ঘটনা। এছাড়া কর্মজীবী নারী, কলেজপড়ুয়া মেয়েরা বাড়িঘরে আসা-যাওয়ার পথেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তবে সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কখনো কখনো নারীরা নিজ আবাসেও নিরাপত্তা পাচ্ছে না। পরিবারের সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা বহুবারই ঘটেছে। আবার কখনো কখনো শিক্ষকের হাত থেকেও রেহাই পায়নি স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা। এগুলো ভীষণ উদ্বেগের বিষয়।
কেন ধর্ষণ থামছে না
* ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘spare the road and sopil the child’ অর্থাৎ ‘শাস্তি না দিলে শাসন হয় না’। ধর্ষণ করে পার পেয়ে গেলে এ ধরনের অপরাধ আরো বাড়বে। তাই শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
* ধর্ষণ মামলায় পর্যাপ্ত স্বাক্ষীর অভাবেও আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, ধর্ষিতা ও স্বাক্ষীরা নিরাপত্তাহীনতার কথা চিন্তা করেও স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন না। এ কারণেও ধর্ষকরা প্রশ্রয় পাচ্ছে।
* আবার অনেকে ক্ষেত্রে তদন্তে ত্রুতি-বিচ্যুতির ফলেও প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। সুরতহাল ও ঘটনাস্থলের আলামত নষ্ট হলেও অপরাধীরা ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
* ধর্ষণের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবার সামাজিকতা ও সম্ভ্রমহানির ভয়ে ধর্ষণের বিষয়টি গোপন রাখতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় অনায়াসে।
* তবে বর্তমানে ধর্ষণের শিকার হয়ে অনেক নারীই সাহস করে মামলা করছেন। তবে আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রচলিত ‘লিগ্যাল প্রসিকিউশন’ এখন পর্যন্ত নারীবান্ধব হয়নি।
পরিসংখ্যানে ধর্ষণ
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কম-বেশি ধর্ষণ বা নারীদের লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনা ঘটে। তবে তা এ উপমহাদেশের তুলনায় খুবই কম। পরিসংখ্যানেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত ৮ মাসে শুধু ধর্ষণই নথিভুক্ত হয়েছে ৮৯২টি।
আর প্রতিবেশী দেশ ভারতে গত বছর প্রতিদিন গড়ে ৮৭টি করে ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। পুরো দেশে নারীর ওপর নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার ৮৬১টি। আর নথিভুক্ত করা হয়নি, এ সংখ্যা নিশ্চয়ই নগণ্য নয়।
ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা
যথাযথ আইনি ব্যবস্থা ও শাস্তি কার্যকরের মধ্য দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্ষণের মাত্রা শূণ্যে নেমে এসেছে কিংবা নেই বললেই চলে। এর মধ্যে মিশর, সৌদি আরব ছাড়াও আরো কিছু দেশে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান রয়েছে। এতে অন্যরা শিক্ষা নিয়ে এমন জঘণ্য অপরাধে জড়াতে সাহস পায় না।
এছাড়া চীনে ধর্ষণ প্রমাণ হলেই আর কোনো সাজা নয়, বিশেষ অঙ্গ কর্তন ও সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আফগানিস্তানে ধর্ষণের বিচার দ্রুত কার্যকর করা হয়। ধর্ষণ করে ধরা পড়ার চার দিনের মধ্যে ধর্ষকের মাথায় সোজা গুলি করে মারা হয়। উত্তর কোরিয়াও গুলি করে হত্যা করার বিধান রয়েছে। আর মঙ্গোলিয়ায় ধর্ষিতার পরিবারের হাত দিয়ে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এর ৯ ধারায় ধর্ষণ এবং ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদির সাজা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অত্র ধারায় একজন অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয়-
* ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন ও দ্রুততম সময়ে বিচার কাজ পরিচালনা করে দ্রুত দণ্ড কার্যকর করা প্রয়োজন।
* বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক সাজার আওতায় আনতে হবে।
* মানবিক মূল্যবোধকে জাগাতে হবে।
* যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেখানে নারী-পুরুষের শরীর, যৌনতা, পরিবার ও গর্ভধারণ বিষয়ক নানা তথ্য ছবিসহ দেয়ার পাশাপাশি পরষ্পরের মধ্যে সম্পর্ক, সম্মতি, আইনি অধিকারের বিষয়াদিও ভালোভাবে তুলে ধরা যেতে পারে।
* অবাধ পর্নোগ্রাফির বিস্তার ঠেকাতে হবে। এ লক্ষ্যে নজরদারি বাড়াতে হবে। আইটি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এর নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে।
* সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্বল্প পরিচয়ের পর কারোর সঙ্গে বাছবিচার না করেই মেলামেশা শুরু করা যাবে না।
* ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটে কোন সাইট দেখছে, তা অভিভাবকদের তদারকি করা প্রয়োজন। অপ্রয়োজনে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল তুলে না দেয়া।
* পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুবুর রহমান জানান, প্রথমত. আইনের কঠোর প্রয়োগ ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত. সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, অবক্ষয় রোধ, সুশিক্ষা ও বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। তৃতীয়ত. কোনো ধর্ষণের ঘটনা পুলিশ ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টিগোচর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। চতুর্থত. ধর্ষণকারীর বিচার দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া ধর্ষণ প্রবণতা ও এর প্রতিকার সম্পর্কে এমএসএফ-হল্যান্ড এর চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী বর্তমানে নাইজেরিয়া মিশনে কর্মরত আকবর হোসেন বলেন, প্রথমেই যেটা বলবো সেটা হলো ধর্ষণ আচরণগত বা মানসিক রোগ নয় বরং এটা ফৌজদারি অপরাধ। তবে হ্যাঁ কিছু ধর্ষণকারীর মধ্যে মানসিক রোগ থাকতে পারে যেটার জন্য ক্রিটিকাল মুহূর্তে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং তখন ধর্ষণের মত ঘৃণিত বা গর্হিত কাজ করে।
হঠাৎ ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণগুলো সাধারণভাবে বলা না গেলেও এর পেছনে বর্তমান দীর্ঘমেয়াদি করোনা পরিস্থিতির একটা যোগসূত্র থাকতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে বিশেষ করে যুবক পুরুষদের মধ্যে এক ধরনের ব্যাপক হতাশা দেখা দিয়েছে। যেটার জন্য কিছু কিছু পুরুষদের মধ্যে সহমর্মিতা কমে যাওয়া, রাগের বহিঃপ্রকাশ, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা, নারীদের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি ধর্ষণের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতা ধর্ষণ বৃদ্ধির প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।
তার মতে, ধর্ষণ কমানোর জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা হিসেবে দ্রুত বিচার করে উদাহরণ সৃষ্টি করা যেতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদিভাবে ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য পারিবারিক শিক্ষা থেকে ধর্মীয় অনুশাসন, নৈতিকতার শিক্ষা খুবই জরুরি। পাশাপাশি সেক্স বা যৌনতাকে স্বাভাবিক একটা বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বিখ্যাত একজন সাইকোএনালিস্ট ফ্রয়েড বলেছেন, অবদমিত ইচ্ছেগুলো বড় হয়ে অসামাজিক বা অনৈতিক কাজের মধ্য দিয়ে নেতিবাচকভাবে প্রকাশিত হয়।
আমাদের দেশে যৌনতাকে খুবই নেতিবাচক এবং খারাপ বিষয় হিসেবে শিশুদের কাছে উপস্থাপন করা হয়, যার জন্য এটা নিয়ে কেউ কথা বলে না, অবদমন করে রাখা হয়। যার জন্য নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি একটা অনৈতিক আকর্ষণ থেকে অনেক যুবক ধর্ষণের মতো ভয়াবহ কাজের মাধ্যমে যৌনতাকে অন্বেষণ করার চেষ্টায় থাকে।
দেশের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কারণ মানুষের নৈতিক অবক্ষয়কে কেবল আইন দিয়ে সংশোধন করা যায় না। এজন্য নিজের ভেতরের বোধশক্তিটাও জাগ্রত করতে হয়।
আর সরকারের একার পক্ষেও ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। সবাই মিলে সামাজিকভাবে এ অপরাধকে প্রতিরোধ করতে হবে। ধর্ষণকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করলেও অনেকাংশে কমে যাবে ধর্ষণ। আর এতেই সব নারী পাবে নির্যাতনমুক্ত ও ধর্ষণমুক্ত নিরাপদ সুন্দর পরিচ্ছন্ন সোনার বাংলাদেশ।