দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬, বিবাহে এগিয়ে রাজশাহী,বিচ্ছেদে খুলনা
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ আর নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। পুরুষের চেয়ে নারী ১৬ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮২ জন বেশি। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১২ হাজার ৬২৯ জন। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জনশুমারিতে এ সংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ। অর্থাৎ গত এক দশকে বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯২০ জন। এবারই প্রথম দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। বহুল প্রতীক্ষিত জনশুমারি ও গৃহগণনায় দেশের জনগোষ্ঠীর এ ফল মিলেছে।
গতকাল বুধবার পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস। স্বাগত বক্তব্য দেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। প্রাথমিক প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন। এ সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়- স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম শুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ। এরপর ১৯৮১ সালের জনশুমারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫ জনে। ১৯৯১ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি ৬৩ লাখে। ২০০১ সালে চতুর্থ আদমশুমারি ও গৃহগণনায় জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ২৪ লাখে। ২০১১ সালে পঞ্চম জনশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪ কোটি ৪০ লাখ। ষষ্ঠ ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এ বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ঢাকা বিভাগে ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭। সর্বনিম্ন বরিশাল বিভাগে ৯১ লাখ ১০২ জন। সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯ হাজার ৩৫৩ জন)। সর্বনিম্ন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা রংপুর সিটি করপোরেশন (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩ হাজার ৪৪৪ জন)।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষ ৯৮ জন। লিঙ্গানুপাতে সর্বোচ্চ ঢাকায় ১০৩.৪০ জন এবং সর্বনিম্ন চট্টগ্রামে ৯৩.৩৮ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধির হার কমেছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী এ হার ছিল ১.৪৬ শতাংশ। ২০২২ সালের শুমারিতে যা রেকর্ড হারে কমে ১.২২ শতাংশে নেমে এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ছিল ঢাকা বিভাগে (১.৭৪ শতাংশ) এবং বরিশালে সর্বনিম্ন (০.৭৯ শতাংশ)। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেও বেড়েছে জনসংখ্যার ঘনত্ব। ২০১১ সালে যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস ছিল ৯৭৬ জনের, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১১৯ জন। সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব ঢাকা বিভাগে (২ হাজার ১৫৬ জন প্রতি বর্গকিলোমিটারে) এবং সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে (৬৮৮ জন প্রতি বর্গকিলোমিটারে)। বিবিএসের শুমারি অনুসারে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৭ জন গ্রামের বাসিন্দা। আর শহরের বাসিন্দা ৫ কোটি ২০ লাখ ৯ হাজার ৭২ জন। দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬। পুরুষ জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ আর নারী জনগোষ্ঠীর ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ। অবিবাহিত জনসংখ্যা ২৮.৬৫ শতাংশ এবং ৬৫.২৬ শতাংশ লোক বিবাহিত। সবচেয়ে বেশি বিবাহিত রাজশাহী বিভাগে (৬৮.৯৭ শতাংশ) এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে (৫৫.৫৯ শতাংশ)। অবিবাহিত হিসাব করা হয়েছে ১০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী জনসংখ্যার মানুষকে ধার্য করে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৯১.০৪ শতাংশ মুসলিম, ৭.৯৫ শতাংশ হিন্দু, ০.৬১ শতাংশ বৌদ্ধ, ০.৩০ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ০.১২ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। বর্তমানে দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ১ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার ২ কোটি ৩৬ লাখ ২ হাজার ৬০৪ জনের (১.৪৩ শতাংশ) কমপক্ষে এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা আছে। যার মধ্যে পুরুষ ১.৬৩ শতাংশ, নারী ১.২৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী খুলনা বিভাগে, সবচেয়ে কম ঢাকায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- দেশে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। এ হারের সর্বোচ্চ ঢাকায় (৭৮.৭৯ শতাংশ) এবং সর্বনিম্ন ময়মনসিংহ বিভাগে (৬৭.০৯ শতাংশ)। পাঁচ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীর মধ্যে মোট ৫৫.৮৯ শতাংশ এবং ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীর মধ্যে ৭২.৩১ শতাংশের নিজস্ব ব্যবহারের মোবাইল ফোন রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে উল্লিখিত বয়সসীমায় যথাক্রমে ৩০.৬৮ ও ৩৭.০১ শতাংশ গত তিন মাসে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। দেশের মোট বাসগৃহের সংখ্যা ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার ৯৫১। একই সঙ্গে ছিন্নমূল বা ভাসমান মানুষ আছে ২২ হাজার ২১৯ জন। দেশে মোট খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ৫১। গড়ে খানার আকার চারজন, এক দশক আগে যা ছিল সাড়ে চারজন।
ভুল ধরিয়ে দেওয়ার আহবান পরিকল্পনামন্ত্রীর
এবারের জনশুমারিতে ভুল থাকতে পারে স্বীকার করে তা দেখিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘জনশুমারি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করা হয়েছে। তবু আমাদের ভুল থাকতেই পারে। আপনারা তা দেখিয়ে দিন। আমরা সংশোধন করব। জনশুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে। এসব তথ্যের অনেক কমার্শিয়াল ভ্যালু আছে।’ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘জনশুমারিতে ডিজিটালাইজেশনের ব্যবহারে আমাদের সক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। জনশুমারিতে খুবই নির্ভরযোগ্য ও যুগোপযোগী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হয়েছি। একটি দেশ এগিয়ে যাওয়ার পেছনে তথ্য লাগে। কীভাবে আমরা এগিয়ে যাব সেভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখান থেকে আমরা ধারণা নিয়ে এগোতে পারব।’ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘অনেকে বিবিএসের তথ্য নিয়ে কথা বলেন। আমরা দেখেছি সফলভাবে বিবিএস তথ্য সংগ্রহ করে। এসডিজি বাস্তবায়নের ১০৫টি সূচক এ জনশুমারি থেকে নেওয়া হবে।’ জনসংখ্যা বেশি ঢাকা বিভাগে, কম বরিশালে : এবারের শুমারি অনুযায়ী বিভাগ হিসেবে ঢাকায় সর্বাধিক ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জনের বসবাস। এর মধ্যে পুরুষ ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮২২ আর নারী ২ কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ৫৫৬ জন। এ বিভাগে ট্রান্সজেন্ডারের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭৭। ঢাকা উত্তর সিটির জনসংখ্যা ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭, দক্ষিণে ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫। সে হিসেবে দুই সিটির মোট বাসিন্দা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন। দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঢাকা উত্তরে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে। সবচেয়ে কম মানুষ বাস করে বরিশাল সিটিতে, ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫১ জন।
সাক্ষরতায় এগিয়ে ঢাকা, পিছিয়ে ময়মনসিংহ
দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে মোট সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ, সর্বনিম্ন ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে নারী-পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক বিবেচনায় পুরুষের সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৫৬ আর নারীর ৭২ দশমিক ৮২ শতাংশ।
বিয়েতে এগিয়ে রাজশাহী, বিচ্ছেদে খুলনা
দেশের বিবাহিত জনসংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে রাজশাহী বিভাগ। অন্যদিকে বিবাহবিচ্ছেদে এগিয়ে খুলনা। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়- প্রতি ১০০ জনের মধ্যে বর্তমানে বিবাহিত ৬৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৬৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ বিবাহিত নিয়ে এগিয়ে রাজশাহী। অন্যদিকে বিবাহবিচ্ছেদ শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। বিভাগভিত্তিক বিবেচনায় শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ নিয়ে বিচ্ছেদে এগিয়ে আছে খুলনা। সিলেট বিভাগে অবিবাহিত জনগোষ্ঠী শতকরা ৩৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অন্যদিকে বিবাহিত জনগোষ্ঠী ৫৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যা অন্য বিভাগের চেয়ে কম। সিলেট বিভাগে বিধবা কিংবা বিপত্নীক রয়েছেন ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। এর তুলনায় বেশি আছে মাত্র এক বিভাগ রংপুরে, ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সংসারী মানুষ বরিশালে। এ বিভাগে তালাক ও বিচ্ছেদের সংখ্যা অন্য বিভাগের তুলনায় খুবই কম।
ভাসমান জনসংখ্যা ২২ হাজার, অধিকাংশই পুরুষ
বর্তমানে দেশে মোট ভাসমান জনসংখ্যা ২২ হাজার ১১৯। এর মধ্যে পুরুষ ১৬ হাজার ৭৮৪ জন, নারী ৫ হাজার ৩৩৫ জন। ভাসমান জনসংখ্যা ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৪৩৯ ও ময়মনসিংহ বিভাগে সর্বনিম্ন ৬৯২ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ৫ হাজার ২১৬, বরিশালে ২ হাজার ১৭৭, খুলনায় ১ হাজার ৩২৫, রাজশাহীতে ১ হাজার ৩০৩, রংপুরে ১ হাজার ৭৪ ও সিলেট বিভাগে ৮৯৩ জন ভাসমান লোকের বসবাস।
বিশুদ্ধ পানি পান করেন শতভাগ মানুষ
সব বিভাগেই শতভাগ মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানি পাচ্ছে। এর মধ্যে গভীর/অগভীর টিউবওয়েলের পানি পান করেন ৮৫ শতাংশ। সাপ্লাই পানি পান করেন ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, বোতলজাত পানি পান করেন শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। কূপের পানি পান করেন শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ।