পিতা মুজিবের ভাষা আন্দোলন থেকে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মীর্জা ও জেনারেল আইয়ুব খানের “মার্শাল ল” বিরোধী আন্দোলনে বার বার গ্রেফতার ও কারাবরণ! শিশু কামাল পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত বারবার। অবুঝ শিশু কামালের এই আত্মত্যাগই বা কম কিসের? বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগষ্ট। শিশু কামালের বঞ্চনা ও আত্মত্যাগের শুরু জন্মের এক মাস না পেরোতেই। এক মাসেরও কম বয়সে ৪৯’র সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গ্রেফতার হয়ে টানা ২৭ দিন জেলবন্দী পিতা মুজিবের অবর্তমানে প্রথম পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হন সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শেখ কামাল। ৪৯’র ২৫ অক্টোবর দ্বিতীয় বার পিতা মুজিবের যত্ন, আদর, ভালবাসা থেকে বঞ্চিত শেখ কামালের আত্মত্যাগের ইতিহাস আরেকটু দীর্ঘ। ২ মাস ২১ দিন বয়সের শেখ কামালকে এবার পিতা ছাড়া থাকতে হয় দীর্ঘ ৬৩ দিন।
অতঃপর ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি শিশু কামালের বয়স যখন মাত্র ৪ মাস ২৭ দিন, তখন তৃতীয়বারের মত পিতা মুজিব গ্রেফতার হয়ে জেলে কাটান টানা ২ বছরেরও বেশি সময়। জেলখানায় অমানবিক নির্যাতন আর টানা ১১ দিন অনশনের পর ভগ্ন শরীর নিয়ে পিতা মুজিব মুক্ত হন ৫২’র ২৭ শে ফেব্রুয়ারি। তখন পিতা মুজিব যেন শিশু কামালের কাছে নিতান্তই বাড়ির এক নতুন মেহমান, নতুন আগন্তুক, অচেনা এক মুখ! ৫২-৫৪ প্রায় দু’বছরে এই অচেনা মুখটিই যেন তার কাছে হয়ে উঠল সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ। দু’বছরের স্নেহ, মমতা, আদর, ভালোবাসায় সিক্ত শিশু কামাল কেবল একটু একটু চিনেছে পিতা মুজিবকে। পিতার প্রতি যেন এক অদৃশ্য আকর্ষণ আর নির্ভরতা জন্মেছে অবুঝ শিশু মনে। তবে হৃদয়হীন, পাষাণ স্বৈরশাসকের তাতে কি আসে যায়? ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে তাকে মুজিবকে গ্রেফতার করতেই হবে।
৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙে দেওয়ার পর পুনরায় মুজিবকে করাচী থেকে ঢাকা ফেরার পর গ্রেফতার করা হল। ৫ বছরেরও কম বয়সী শেখ কামাল এবার চতুর্থবারের মত পিতার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হল। এবারের কষ্টটা একটু বেশি। কারন চেনার পর এবারই প্রথম পিতাকে ছাড়া থাকতে হল তাকে। দীর্ঘ প্রায় ৭ মাস কারাভোগের পর যখন ২৩ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়ে বাড়ীতে আসলেন, ততোদিনে শিশু কামাল যেন অনেকটাই ভুলে গেছে পিতা মুজিবকে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মীর্জা কর্তৃক ‘মাশাল ল’ জারির পরে ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। তখন কামালের বয়স প্রায় ৯ বছর। বুঝতে শেখার পর প্রথম আঘাত। টানা ৩ বছরেরও বেশি সময় বঙ্গবন্ধুর এই জেলজীবন ছিল সম্ভবত বালক শেখ কামালের জন্য সবচেয়ে কষ্টের।
বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দেওয়ার পর যখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়, তখন ১৯ বছরের টগবগে যুবক কামাল ৬ দফার পক্ষে স্কুল, কলেজে প্রচারণা চালিয়েছেন। ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেছেন। পিতা মুজিবের মুক্তির আন্দোলনে রাজপথে শরিক হয়েছেন। ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ছিলেন শেখ কামাল।
ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ব্যাচের স্পেশাল ট্রেনিংয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডেট অফিসারদের অন্যতম। সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছেন ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে। ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পথিকৃৎ।
বাঙালীর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীকার, স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম সবখানেই যার আত্মত্যাগ তাকে করেছে মহিমান্বিত। পৃথিবীর সব পিতার জন্য ২৬ বছরের এই ক্ষণজন্মা পুরুষের জীবন যেমন অনুপ্রেরণার উৎস, তেমনি সব শিশু ও যুবকের জন্য আজীবন আত্মত্যাগ ও সাহসের প্রতীক হয়ে রবে।
৫ আগস্ট ২০২২, ৭৩ তম জন্মবার্ষিকীতে বহুগুণে গুনান্বিত জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
লেখকঃ- মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।