জেনে নিন জামের উপকারিতা
কালো রঙের ছোট ফলটির সঙ্গে আমাদের সবারই পরিচয় রয়েছে। অন্য সব মৌসুমি ফলের তুলনায় জামের স্থায়ীকাল কম। একটি গ্রীষ্মকালীন ফল। স্বাদে কোনটি মিষ্টি আবার কোনটি টক-মিষ্টি। এর পুষ্টিগুণ অনেক। ফলটি চিকিৎসা ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশের সর্বত্র কম-বেশি পাওয়া যায়।
জাম ভারতবর্ষ থেকে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়েছে এবং বর্তমানে এটি সাবেক বৃটিশ উপনিবেশগুলোতে বেশ দেখা যায়। জাম সাধারণত তাজা ফল হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এ থেকে রস, স্কোয়াশ ও অন্যান্য সংরক্ষিত খাদ্য তৈরি করা যায়।
জামের পরিচিতি : ইংরেজি নাম Java plum, Jambul, Malabar plum. বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium cumini। জাম নানা দেশে নানা নামে পরিচিত, যেমন- জাম্বুল, জাম্ভুল, জাম্বু, জাম্বুলা, জাভা প্লাম, জামুন, কালোজাম, জামব্লাং, জাম্বোলান, কালো প্লাম, ড্যামসন প্লাম, ডুহাট প্লাম, জাম্বোলান প্লাম, পর্তুগিজ প্লাম ইত্যাদি। তেলেগু ভাষায় একে বলা হয় নেরেদু পান্ডু, মালায়ালাম ভাষায় নাভাল পাজহাম, তামিল ভাষায় নাভা পাজহাম এবং কানাড়া ভাষায় নেরালে হান্নু। ফিলিপাইনে একে বলা হয় ডুহাট।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস : জগৎ- উদ্ভিদ, শ্রেণীবিহীন-সপুষ্পক উদ্ভিদ, শ্রেণীবিহীন- রোজিডস, বর্গ- মির্টালেস, পরিবার- মির্টাসিয়া, গণ- সিজিজিয়াম, প্রজাতি-এস. ক্যুমিনি।
বিবরণ : এই ফলটি ১ থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার লম্বা, প্রায় আয়তাকার। গাছ ১৪ থেকে ৬০ ফুট বা এর বেশিও লম্বা হতে পারে। পাতা সরল, বড়, চামড়া পুরু এবং চকচকে। গাছ চির সবুজ। চকচকে পাতা এবং চিরসবুজ হবার কারণে এর আলংকরিক মান বেশ ভালো। জাম গাছে মার্চ এপ্রিলে ফুল আসে। জামের ফুল ছোট এবং ঘ্রানওয়ালা। মে জুন মাসে ফল বড় হয়। ফলটি লম্বাটে ডিম্বাকার। শুরুতে এটি সবুজ থাকে যা পরে গোলাপী হয় এবং পাকলে কালো বা কালচে বেগুনি হয়ে যায়। এটি খেলে জিহ্বা বেগুনি হয়ে যায়। দুই জাতের জাম পাওয়া জায়। জাতগুলো হলো ক্ষুদি- খুব ছোট জাত এবং মহিষে- বেশ বড় ও মিষ্টি। এটি বর্ষাকালে পাওয়া যায়। ফলের গা কালো এবং খুব মসৃণ পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা। ফলের বহিরাবরণের ঠিক নিচ থেকেই গাঢ় গোলাপী রংয়ের টক মিষ্টি শাস।
প্রতি ১০০ গ্রাম পুষ্টিগত মান
শক্তি ৬০ কিলোক্যালরী, শর্করা ১৫.৫৬ গ্রাম, স্নেহ পদার্থ ০.২৩ গ্রাম, প্রোটিন ০.৭২ গ্রাম, ভিটামিন এ ৩.০ আন্তর্জাতিক একক, থায়ামিন বি১ ০.০০৬ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন বি২ ০.০১২ মিলিগ্রাম, ন্যায়েসেন বি৪ ০.২৬০ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড বি৫ ০.১৬০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ ০.০৩৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৪.৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৯ মিলিগ্রাম, লোহা ০.১৯ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৭৯ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১৪ মিলিগ্রাম, পানি ৮৩.১৩ গ্রাম
জামের উপকারিতা
বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া এবং চীনে জামের ব্যবহার হয়ে আসছে। হেকিমী, আয়ুর্বেদী এবং ইউনানী চিকিৎসাতেও জাম ব্যবহার করা হয়। জামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, জিংক, কপার, গ্লুকোজ, ডেক্সট্রোজ ও ফ্রুকটোজ, ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও স্যালিসাইলেটসহ অসংখ্য উপাদান। যা স্বাস্থ্যের বিভিন্নভাবে উপকার করে থাকে।
মানসিকভাবে সতেজ রাখে : জামে গ্লুকোজ, ডেক্সট্রোজ ও ফ্রুকটোজ রয়েছে, যা মানুষকে জোগায় কাজ করার শক্তি। বয়স যত বাড়তে থাকে, মানুষ ততই হারাতে থাকে স্মৃতিশক্তি। জাম স্মৃতিশক্তি প্রখর রাখতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস নিরাময়ে সাহায্য করে : ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য জাম ভীষণ উপকারী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত জাম খাওয়ার ফলে ৬.৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিক কমে গেছে। এটি রক্তে চিনির মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। জাম ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে শরীর সুস্থ রাখে। এক চা চামচ জামের বীচির গুঁড়া খালি পেটে প্রতিদিন সকালে খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি-এর অভাবজনিত রোগ দূর করে : জামে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি। এই ফল ভিটামিন সি-এর অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া মুখের দুর্গন্ধ রোধ, দাঁত মজবুত, মাঢ়ি শক্ত এবং মাঢ়ির ক্ষয়রোধেও জামের জুড়ি নেই । এতে বিদ্যমান পানি, লবণ ও পটাসিয়ামের মতো উপাদান গরমে শরীর ঠাণ্ডা এবং শারীরিক দুর্বলতাকে দূর করতে সক্ষম। জামে রেয়েছে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, যা রক্তস্বল্পতা দূর করে।
হার্ট ভালো রাখে : জাম রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃৎপিণ্ড ভাল রাখে। এছাড়া শরীরের দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে দেহের প্রতিটি প্রান্তে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। জাম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করে : জামে কম পরিমাণে ক্যালোরি থাকে, যা ক্ষতিকর তো নয়ই বরং স্বাস্থ্যসম্মত। তাই যারা ওজন নিয়ে চিন্তায় আছেন এবং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, তারা খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন জাম।
ক্যান্সার প্রতিরোধে উপকারী : জাম মুখের ভেতর উৎপাদিত ক্যান্সারের সহায়ক ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব থেকে দেহকে রক্ষা করে মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রঙিন ফলের ভেতর যে পরিমাণ যৌগিক উপাদান রয়েছে, এর মধ্যে জামে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ যৌগিক উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করে। জাম লড়াই করে জরায়ু, ডিম্বাশয় ও মলদ্বারের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে।
সাদা বা রক্ত আমাশয় : জামের কচি পাতার রস ২-৩ চা-চামচ একটু গরম করে ছেঁকে নিয়ে খেলে ২-৩ দিনের মধ্যে সেরে যায় সাদা বা রক্ত আমাশয়।
অরুচি ও বমিভাব : পাকা জাম লবণ মাখিয়ে ৩-৪ ঘণ্টা রেখে, সেটা চটকে পুঁটলি বেঁধে টানিয়ে রাখলে যে রস ঝরে পড়বে, সেটা ২০-২৫ ফোঁটা প্রয়োজনবোধে এক চা চামচ পানি মিশিয়ে খেতে দিলে পাতলা দাস্ত, অরুচি ও বমিভাব কমে যায়।
শয্যামূত্র : এ রোগে শিশু-বৃদ্ধ অনেকেই অসুবিধায় পড়েন এবং অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের জন্য মায়েদের ভুগতে হয়। এক্ষেত্রে ২-৩ চা চামচ জাম পাতার রস (বয়স অনুপাতে মাত্রা) ১/২ চা চামচ গাওয়া ঘি মিশিয়ে প্রতিদিন একবার করে খাওয়ালে এক সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপকার হবে।
জ্বরের সঙ্গে পেটের দোষ : যাদের জ্বরের সঙ্গে পেটের দোষ থাকে, তারা এ পাতার রস ২-৩ চা-চামচ একটু গরম করে ছেঁকে খেলে উপকার হয়।
এছাড়া জামে রয়েছে ফাইটো কেমিক্যালস আর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, এবং সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি দেয়। প্রতিরোধ করে ইনফেকশনের মতো সমস্যাও। জামে পাওয়া গেছে অ্যালার্জিক নামে এক ধরনের এসিডের উপস্থিতি, যা ত্বককে করে শক্তিশালী। ক্ষতিকর আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মির প্রভাব থেকে ত্বক ও চুলকে রক্ষা করে। এ অ্যালার্জিক এসিড ক্ষতিকর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
আধাপাকা (ডাঁসা) জাম খাওয়া উচিত নয়। খালি পেটে জাম খাবেন না এবং জাম খাওয়ার পর দুধ খাবেন না। পাকা ফল ভরা পেটে খেলে অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিকভাব হতে পারে।