গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চলছে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায়
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলছে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায়। দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও কর্মরত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নির্ধারিত সময় ও নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা। ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে এসে হচ্ছেন বিভিন্ন রকমের হয়রানির শিকার। এখানে চিকিৎসা না দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে রেফার টিকেট। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে ময়লা আবর্জনা ও দুর্গন্ধে সেবা প্রত্যাশিদের নাভিশ্বাস চরমে। যেন দেখার কেউ নেই।গাংনীর থানা পাড়ার জোসনা খাতুন চিকিৎসা নিতে আসেন গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মঙ্গলবার বেলা বারোটার সময়। ৫ টাকার টিকিট কেনেন বহির্বিভাগ টিকিট কাউন্টার থেকে । সেবা নিতে যান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ১০৯ নম্বর কক্ষে।উক্ত কক্ষে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন ডাক্তার মাসুদুর রহমান । শুধু জোছনা খাতুনই নয়, এ সময় আরো চার থেকে পাঁচ জন রোগী টিকিট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বেলা সাড়ে ১২ টা বাজার সাথে সাথে তিনি চিকিৎসা দেয়ার সময় শেষ বলে ১০৯ নম্বর পক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়েন। কয়েকজন সেবা প্রত্যাশীরা সরকারি নির্ধারিত সময় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমার ৮টা থেকে সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত ডিউটি। তাই আমি আর রোগী দেখতে পারব না। মাইলমারি গ্রামের রেক্সোনা খাতুন জানান, বেলা ১২ টা বাজার সাথে সাথে টিকিট কাউন্টার থেকে আমাকে আর টিকিট দেয়নি। কাউন্টার তালা দিয়ে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেন কাউন্টারে দায়িত্ব থাকা মকলেছুর রহমান ও লালচাঁদ। সকাল আটটা থেকে বেলা ২:৩০ মিনিট পর্যন্ত সেবা প্রত্যাশীদের টিকিট দেওয়ার সরকারি নিয়মের মধ্যে থাকলেও মোকলেছুর রহমান ও লালচাঁদ হোসেন বেলা ১২ টা বাজলেই টিকিট দেয়া বন্ধ করে দেন। গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাউন্টা রের মোকলেছুর রহমান ও লাল চাঁদ হোসেনর তৈরি করা নিয়ম। সরকারি সময় ও নিয়মিত অক্ষর করেন না তারা।
অপরদিকে মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মাসুদুর রহমান ও সরকার নির্ধারিত সকাল আটটা থেকে ২ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা দেবার নিয়ম থাকলেও তিনি মনগড়া নিয়ম করেছেন সকাল ৯ টা থেকে বেলা ১২ টা। কক্ষ ভর্তি রোগী টিকিট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও চিকিৎসা না দিয়ে সাড়ে ১২ টায় বেরিয়ে পড়েন । এটিও তার মনগড়া তৈরী সময়। জরুরী বিভাগে সার্বক্ষণিক মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও মাঝেমধ্যে তাদের দেখা মেলে। সহকারী মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) দিয়ে চলে জরুরী বিভাগের সমস্ত চিকিৎসা। রোগী আসলে রোগীর স্বজনদের ডাক্তার খুঁজতে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। দায়িত্বেরত মেডিকেল অফিসারে মোবাইল করে ডেকে আনতে হয়। অবস্য অনেক সময় ডাক্তার খোঁজার এ দায়িত্বটা পালন করেন স্যাকমোরা। অপর একটি সূত্র জানায়,স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন কক্ষে রোগী দেখার সময় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা যেয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। ফলে সেবা প্রত্যাশীরা সেবা না পেয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। চিকিৎসকরা বিক্রয় প্রতিনিধিদের চাপে রোগীদের রোগ নির্ণয়, ব্যবস্থাপত্র ও চিকিৎসা দিতে গিয়ে লোকলজ্জায় পড়েন। একসময় দুপুর ২ টার পর থেকে ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা ডাক্তার ভিজিট করার সময় নির্ধারিত করা থাকলেও বর্তমানে সে নিয়ম আর মানা হচ্ছে না। বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃপঃ কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) সুপ্রভা রানী যোগদান করার পর থেকেই ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা সব সময়ের জন্য দখলে নিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও ঠিকমত অফিস করেন না। তিনি সার্বক্ষিণিক অফিস চত্বরে অবস্থান করার কথা থাকলেও তিনি সে নিয়মেরও তোয়াক্কা করেন না।
জানাগেছে,১৫ জন মেডিকেল অফিসার ও দুই জন জুনিয়র কনসালটেন্ট দিয়ে চলছে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা। এসকল চিকিৎসকরা সেবা দেয়ার মানসিতা নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করলে উন্নত সেবা পাবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। কিন্তু চিকিৎসকরা দায়িত্বে অবহেলা করলে সেবা বঞ্চিত হবে সেবা প্রত্যাশীগণ।
এ বিষয়ে ডাক্তার মাসুদুর রহমান এর সাথে কথা বলতে সাড়ে ১২ টার সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে ১০৯ নম্বর কক্ষ তালাবন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার মোবাইল নাম্বারে ফোন করা হলে তিনি জানান,আমি ১০১ নাম্বার কক্ষে আছি। ১০১ নাম্বার কক্ষে গিয়েও দেখা মেলেনি ডাক্তার মাসুদুর রহমানের সাথে। উক্ত কক্ষের বাহিরে তালা দেয়া। পরে তিনি আর মোবাইল রিসিভ করেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তদিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেসের একজন কর্মচাকরী জানান, মাসুদুর রহমান স্যার ওষুধ কোম্পানির লোকজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকে যেখানে গর্ভবতী মায়েরা চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন সেই দরজার উপরের টয়লেটের পাইপ ভেঙ্গে মলমুত্র পড়ছে। মলমুত্রের দুর্গন্ধে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিলের ব্যাপার। যেখানে মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনার বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়, সেখানেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। করোনাভাইরাসের টিকা নিতে আসা মুনতাসির জামান জানান, যে দরজা দিয়ে করোনাভাইরাসের টিকা নিতে যাবো সেই দরজার সামনে মলমুত্র পড়ে মানুষ যাবার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আমি সেবা না নিয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছি। দ্রুত টয়লেটের পাইপ মেরামত করা না হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি আর মানুষের দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না।
পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে সেবা নিতে আসা গাড়াডোব গ্রামের মমতাজ খাতুন জানান, আমি চেকাপ করতে এসেছি। দরজায় ঢুকতেই দেখি টয়লেটের পাইপ ভেংগে মলমুত্র পড়ছে। এদেখে আমার বমি শুরু হয়ে যায়। কেউ সেখানে সেবা নিতে যেতে পারছনা। প্রতিবছরে লক্ষাধিক টাকা অন্যান্য বরাদ্দ পেলেও সে টাকাও উত্তোলন করে নেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। অথচ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি দিনদিন চিকিৎসা নেয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে একটি দৃষ্টিনন্দন ফুলবাগান থাকলেও সেখানকার গাছগুলি অযত্ন অবহেলায় মরে যাচ্ছে। ফুলবাগানটি পরিচর্যার অভাবে আস্তে আস্তে প্রায় বিলুপ্তির পথে। দীর্ঘদিনের এই ফুলবাগানটি পরিচর্যা করে আগের রূপ ফিরিয়ে আনার দাবি স্থানীয়দের। সেই সাথে গাংনীর একমাত্র চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটির নিয়মশৃংখলা ফিরিয়ে আনার দাবী করেন গাংনীবাসী।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আব্দুল্লাহ আল মারুফ জানান,স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একজন চিকিৎসক সকাল ৮ টায় অফিসে আসবেন এবং ২:৩০ মিনিট পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন। এ নিয়ম কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের জন্যই সমান ও সরকার নির্ধারিত। এর ব্যতিক্রম হলেই সেটি অনিয়ম ও মনগড়া। বহির্বি বিভাগের টিকিট বিক্রিও করবেন সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। যদি না করা হয় সেটিও অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলা। এসব বিষয় স্বীকার করে তিনি বলেন, যারা সরকার নিয়মের ব্যতিক্রম করে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পঃপঃকর্মকর্তা ( ইউএইচএফপিও) সুপ্রভা রানীর সাথে কথা বলতে কয়েকবার অফিস কক্ষে যাওয়া হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি বাহিরে গেছেন বলে জানা যায়। তবে মোবাইল ফোনে সরকারি নাম্বারে ফোন করা হলে সরকারি মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।