গাংনীর পা হারানো আকলিমার জীবনসংগ্রাম
সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা হারানোর যন্ত্রণা ও মনো কষ্টে আল্লাহর কাছে মৃত্যুও কামনা করেছেন কলেজ ছাত্রী আকলিমা। একেতো নারী তার ওপর আবার পঙ্গুত্ব। হাসপাতালের বিছানায় এক বছর অসহায় জীবনযাপন করেছেন তিনি। মৃত্যু কামনার পরও তার মৃত্যু হয়নি, বরং সাফলতা অর্জনের সাহসটুকু তিনি পেয়েছেন। গর্ভধারিণী মমতাময়ী মায়ের পরামর্শে আকলিমা পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। এখন তিনি একজন স্বনামধন্য স্কুলশিক্ষক। সে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রাইপুর গ্রামের হাজী জোয়াদ আলীর মেয়ে।
জানা গেছে, ২০০৬ সালের ৬ মার্চ মেহেরপুর সরকারি কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আকলিমা খাতুন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দুটি পা। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে এক বছর তার চিকিৎসা করানো হলেও পা দুটি আর সচল করা যায়নি। কোমর থেকে নিচের অংশটি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সে। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে তার মতো অসংখ্য মানুষকে দেখে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। আবার লেখাপড়া শুরু করে।
পঙ্গুত্ব বরণ করার পর আকলিমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। জীবনের সব আশাভরসা শেষ এই ভেবে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করতেন আর অঝোরে কাঁদতেন। সে সময় তার পাশে কাউকে না পেলেও মমতাময়ী মা তাকে ছেড়ে যাননি। সব সময় আশা যুগিয়েছেন। মায়ের পরামর্শে আকলিমা আবারও পড়ালেখা শুরু করেন। অদম্য এই মেধাবী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দেন এবং কৃতকার্য হন। বর্তমানে তিনি গাংনী উপজেলার রায়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত। পায়ে হেঁটে আসার সামর্থ্য হারালেও এখন সব ধরনের চলাচল তার হুইল চেয়ারে।
আকলিমা জানান, তার জীবনের এই গল্পটা এতটা সহজ ছিল না। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে এতদূর। জীবনের সেই দুঃসময়ে একমাত্র মা ছাড়া পরিবারের কেউ তেমন সহযোগিতা করেনি। ভাইয়েরা বলেছিল অযথাই ওর পড়াশোনার পিছনে টাকা খরচ করে কী লাভ? প্রতিবন্ধীরা যে সমাজের বোঝা নয়, তাদের একটু সুযোগ করে দিলে সমাজে তারাও যে ভালো ভূমিকা রাখবে সেটা পরিবারের লোকজনকে বিশ্বাস করানোটা ছিল এক রকম চ্যালেঞ্জ। এখন পাশে অনেকেই আছেন এবং পরিবারের লোকজনও তার পাশে রয়েছে বলেও জানান আকলিমা।
আকলিমার মা মমতাজ খাতুন জানান, আকলিমা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। দুুটি পা অচল হলেও লেখাপড়া বন্ধ করতে দেয়া হয়নি। ছোট বেলা থেকেই সে মেধাবী। তার ওপর ভরসা ছিল, তাই নানা ধরনের বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেও তার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছি। এখন সে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করছে। সে তার সংসারের নিজের সব কাজ নিজেই করে, যেটি পারে না তখন তাকে সাহায্য করা হয়। প্রতিটি বাবা-মার উচিত তার প্রতিবন্ধী, অক্ষম সন্তানকে বোঝা মনে না করে ভালো কিছু করার সুযোগ করে দেয়া।
ওই বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, আকলিমা অন্যান্য শিক্ষকদের মতো শিক্ষা দেন। ভালোভাবে পাঠদান করান। সময়মতো স্কুলে আসেন। তিনি খুব আন্তরিক মানুষ। কেউ স্কুলে না আসলে হুইল চেয়ারে করে তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেন। কখনও কারও সঙ্গে অসদাচরণ করেন না।
বিদ্যালয়ের প্রধান ফৌজিয়ারা খাতুন জানান, আকলিমা শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও আর পাঁচজনের মতোই তার কাজ নিজে করেন এবং প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করেন। তিনি কোনো দিন দেরি করে স্কুলে আসেন না। শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তান মনে করে পড়ালেখা করান।
গাংনী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. নাসির উদ্দিন জানান, আকলিমা দৈহিকভাবে বাধাগ্রস্ত হলেও মানসিকভাবে অবিচল। সাধারণ মানুষের মতোই সব কিছ– করেন। শিক্ষাদান বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া সঠিক সময়ে পাঠ দানে তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তাকে দেখে সমাজের আরও যারা এরকম সমস্যায় রয়েছে তারা ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।