গাংনীতে স্বামীর বাড়িতে নিহত ইবি ছাত্রীর ময়নাতদন্তে নয়-ছয়
স্বামীর বাড়িতে হত্যাকান্ডের অভিযোগে ইবি ছাত্রী নিশাত তাসনিম উর্মির মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। সুরতহাল রিপোর্টে হত্যাকান্ডের আশংকা থাকলেও মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় পুলিশ ও নিহতের পরিবার। তবে সেই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার এবং পুলিশের পক্ষ থেকে পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে ভিসেরা রাসায়নিক পরীক্ষাগারে না পাঠিয়ে আইন বহির্ভূতভাবে আটকে রাখা হয় মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে। আবার টাকা দিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পক্ষে নেওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। তাহলে কি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নয় ছয় হতে পারে ? এমন আশংকা করছে নিহতের পরিবার ও স্বজনরা।
গেল ৮ সেপ্টেম্বর রাতে মেহেরপুরের গাংনীর কাথুলী মোড় পাড়ায় স্বামীর বাড়িতে ইবি ছাত্রী উর্মিকে নির্যাতন ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এমন অভিযোগে নিহতের পিতা গাংনী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার আসামি হিসেবে নিহত ইবি ছাত্রীর স্বামী ও শশুর জেল হাজতে রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে গাংনী হাসপাতালে উর্মির মরদেহ নিয়ে যায় তার স্বামীর পরিবারের লোকজন। আত্মহত্যা বলে তারা দাবি করলেও নিহতের পরিবার ও পুলিশের সন্দেহ হয়। প্রাথমিকভাবে তারা এটিকে হত্যাকা- বলে চিহ্নিত করে। ওই রাতেই পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করে। এতে উঠে আসে শরীরের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকান্ড বিষয়ে সন্দেহজনক আঘাতের নানা চিহ্ন। পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর নিহতের পিতা গোলাম কিবরিয়া বাদি হয়ে গাংনী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। উর্মির মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মেহেরপুর জেনারেল হাসপতালে প্রেরণ করে গাংনী থানা পুলিশ। ময়ানাতদন্তের শুরু থেকেই নানা আলোচনা, টাকা দিয়ে ময়নাতদন্ত ম্যানেজ করার গুঞ্জন এবং প্রাথমিক ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিয়ে চিকিৎসকের অনিহার বিষয়টি সমালোচনায় রুপ নেয়। ভিসেরা নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পেলেই পুর্নাঙ্গ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে এমন দাবি করে আসছিলেন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মকলেছুর রহমান পলাশ। তাহলে সেই ভিসেরা রিপোর্ট কোথায় গেছে? কবেই বা আসবে কাঙ্খিত সেই রিপোর্ট ? কেন দেরি হচ্ছে ? বাদি পক্ষের এমন নানা প্রশ্ন আর শংকা থেকে অনুসন্ধান শুরু হয়।
তাহলে এবার দেখা যাক ভিসেরা নমুনার অবস্থা কী। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিসেরা রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহজনক নানা কর্মকা-। গেল ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় উর্মির ভিসেরা কৌটাবদ্ধ অবস্থায় মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালেই পড়ে আছে। তাহলে আরএমও কেন বার বার দাবি করছেন ভিসেরা রিপোর্টের জন্য নমুনা পাঠানো হয়েছে ? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে হাসপাতাল থেকে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তার উপর দায় চাপানো হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে নমুনা নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তারা। কি‘ এ দায় পুলিশের নয় বলে বিষয়টি স্পষ্ট করেন গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক।
এ বিষয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর যোগাযোগ করা হলে ওসি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, হাসপাতাল থেকে নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক ময়নাতদন্ত রিপোর্টের সাথে ভিসেরা নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠাতে একটি চিঠি ইস্যু করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত পুলিশের কিছু করার নেই। এখন পর্যন্ত (৩০ সেপ্টেম্বর) কোন চিঠিপত্র হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেয়নি বলে নিশ্চিত করেন গাংনী থানার ওসি।
ওসির বক্তব্যের পর আরও ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। হাসপাতালের আরএমও বলছেন ভিসেরা রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পেলেই পুর্নাঙ্গ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে। অথচ সেই ভিসেরা আজ পর্যন্ত (৩০ সেপ্টেম্বর) কেন পাঠানো হয়নি ? এর রহস্য কী ? তাহলে কি আসামি পক্ষ টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করছে বলে যে গুঞ্জন রয়েছে তাই সত্যি হতে যাচ্ছে ? এমন প্রশ্ন ছিল মামলার বাদির।
এদিকে ভিসেরা রিপোর্ট না পাঠিয়ে হাসপাতালে ফেলে রেখে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করার বিষয়টি আটকে ধরেন সাংবাদিকরা। তখন তড়িঘড়ি করে প্রাথমিক ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও পুলিশের কাছে চিঠি ইস্যু করা হয় গত ১ অক্টোবর। সেই চিঠির নির্দেশনা পেয়ে উর্মির মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা গাংনী থানার এসআই শাহীন মিয়া নমুনা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে ? নিয়মানুযায়ী ভিসেরা রিপোর্ট ৭২ ঘন্টার মধ্যে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে প্রেরণের কথা। অথচ ২২ দিন কেন নমুনা আটকে রাখা হলো তার সদুত্তোর মেলেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
এবার আসি প্রাথমিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের দিকে। সেখানে স্বাক্ষর করেছেন তিন জন চিকিৎসক। এরা হলেন- মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা: মকলেছুর রহমান, মেডিকেল অফিসার ডাঃ বেলাল হোসেন সুমন ও ডাঃ তারেক আহমেদ। ময়নাতদন্তের নির্দিষ্ট ফরমের মেডিকেল অফিসারের মতামতের ঘরে ডাঃ বেলাল হোসেন সুমনের ইংরেজীতে লেখা মতামতের অর্থ হচ্ছে – ভিসেরা রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন ময়নাতদন্ত নিয়ে অভিজ্ঞ অনেকে। তারা বলেন, একটি মরদেহ দেখে হত্যা না আত্মহত্যা তা নির্ণয় করার মেডিকেল জ্ঞান তাদের অবশ্যই রয়েছে। তাহলে প্রাথমিক রিপোর্ট কেন এড়িয়ে যাওয়া হল ? এ প্রশ্ন এখন গাংনীর বিভিন্ন মহলের।
এই প্রাথমিক ময়ানাতদন্ত রিপোর্ট নিয়েও আরেক সংশয় সৃষ্টি হয়েছে বাদি পক্ষে। ভিসেরা পাঠাতে সময়ক্ষেপণ, রিপোর্ট পাঠানো নিয়ে পুলিশের উপর দায় চাপানো, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের অসম্পূর্ণ মতামত প্রদান এবং ভিসেরা হাসপাতালে ফেলে রাখার বিষয়টি ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছে। তবে কেন এতোদিন ফেলে রাখা হলো ? কেনইবা মতামত রিজার্ভ করা হল ? এমন প্রশ্নের উত্তর চেয়ে বারবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও ডাঃ বেলাল হোসেন সুমন কল রিসিভ করেননি।
তবে বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন আরএমও ডাঃ মকলেছুর রহমান। তিনি দাবি করেন, মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা যখন ভিসেরা নিতে আসেন তখন চিঠি করে দেওয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে না চাওয়া পর্যন্ত চিঠি করা হয় না
ময়ানাতদন্ত প্রতিবেদন বদলে ফেলার কোন সুযোগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, মরদেহের নানা পরীক্ষা ও ভিসেরা রিপোর্ট পর্যালোচনা করেই প্রকৃত ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা করতেছি। তিনি বাদি পক্ষের লোকজনকে আশ্বাস’ করে বলেন, চিকিৎসকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকেই সঠিক ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিবেন।
এ বিষয়ে মামলার বাদি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে যা হচ্ছে তা রীতিমতো আমার কাছে ভয়ংকর বিষয়। আমি তো সন্তান হারিয়েছি। নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি সকলের কাছেই পরিস্কার। একটি নিশ্চিত বিষয় নিয়ে কেন এত ধূম্রজাল তা বুঝতে পারছি না। তবুও চিকিৎসক ও পুলিশের প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। তবে সঠিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ঠ উর্দ্ধতন কর্তপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এদিকে সাংবাদিকদের অনুসন্ধান আর বাদি পক্ষের অভিযোগের বিষয়টি নজরে আনলে মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডাঃ জওয়াহেরুল আলম বলেন, কোনভাবেই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বদলানো যায় না। এ বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি।
উল্লেক্ষ্য, গাংনীর বাঁশবাড়ীয়া গ্রামের গোলাম কিবরিয়া ও চিৎলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক লায়লা আরজুমান বানুর বড় মেয়ে নিশাত তাসনিম উর্মির বিয়ে হয় গাংনীর কাথুলী মোড় পাড়ার ব্যবসায়ী হাসেম শাহের ছেলে প্রিন্সের সাথে। প্রিন্স কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ আর উর্মি ইবি ফোকলোর স্ট্যাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। তাদের ১৩ মাস বয়সী এক পুত্র সন্তান রয়েছে। গেল ৮ সেপ্টেম্বর রাতে উর্মিকে পিটিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তার পরিবার। এমন অভিযোগে তাদের নামে মামলা দায়ের করে নিহতের পরিবার। ওই মামলায় উর্মির স্বামী ও প্রিন্সকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে গাংনী থানা পুলিশ। বর্তমানে তারা মেহেরপুর জেলা কারাগারে হাজতবাসে রয়েছেন। মামলার অপর আসামি প্রিন্সের মা পলাতক রয়েছেন।