গাংনীতে কৃষি প্রণোদনা কোন কাজে আসছেনা
খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে উন্নত জাতের ফসল আবাদের লক্ষ্যে সরকার কৃষকদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফসলের বীজ ও সার প্রণোদনা দিলেও তা কাজে আসছে না কৃষকদের। মৌসুম শুরুতে প্রণোদনা দেয়ার কথা থাকলেও ফসল আবাদের অন্তত মাস খানেক পর প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে চাষিদের। অপরদিকে ৯টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের স্বজন প্রীতির কারণেও প্রকৃত চাষিদের বঞ্চিত করে চাষী নয় এমন মানুষদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ফলে ওই প্রণোদনার বীজ ও সারের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে কাল বাজারে। এতে সরকারের মোটা অংকের টাকা অপচয় হলেও মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে কৃষি অফিস বলছে, সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কৃষক নির্বাচনের পত্র দেরীতে আসায় প্রণোদনা বিতরনে বিলম্ব হয়েছে।
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসের হিসেব মতে, উপজেলায় ২৪০০ জন চাষিকে গম, ১০০০জন জনকে ভুট্টা, ৫৫০০ জনকে সরিষা, ৭৬০ জনকে কলাই বীজ, ১০০ জনকে মুগ, ২৫০ জনকে মসূর ও ৫০ জনকে পেঁয়াজ বীজ ও সার প্রদান করা হয়। মাস খানেক আগে কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মরত উপসহকারী কৃষি অফিসার সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে অবহিত করেন কৃষি অফিস। জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার প্রকৃত চাষি ছাড়াও চাষি নন এমন লোকজনদেরকে তালিকা ভুক্ত করেন। এদের মধ্যে অনেকেই নিকট আত্মীয় ও রাজনৈতিক আস্থাভাজন রয়েছে। এক দিকে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে কৃষকদের নামের তালিকা প্রাপ্তি অন্যদিকে দেরীতে বীজ সরবরাহের কারণে সঠিক সময়ে কৃষকদের হাতে তা পৌঁছায়নি। বাধ্য হয়ে চাষিরা নিজে বাজার থেকে বীজ ক্রয় করে তা বপন করেছেন ক্ষেতে। বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে নতুন নতুন জাতের ফসল আবাদের।
চাষীরা গাংনীর চোখ’কে জানান, এভাবে প্রণোদনা না দিয়ে এই অর্থ যদি সারের উপর ভুতর্‚কি বাড়ানো হয় তাহলে সকল চাষী উপকৃত হবেন।
এদিকে জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির কারনে অনেকে সার ও বীজ সহায়তা পেয়েছেন। যাদের অনেকেই চাষের সাথে সম্পৃক্ত না। আবার অনেকেই আছেন যারা নিজেরা কখনও চাষ করেন না। এমন মানুষগুলো প্রণোদনার সার ও বীজ উত্তোলন করে কাল বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। আবার সময়ম মতো ডাল জাতীয় ফসলের বীজ হাতে না পেয়ে চাষীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কৃষি অফিস থেকে যখন বীজ প্রদান করা হয়েছে তখন ডাল জাতীয় ফসলের বীজ বপনের সময় পেরিয়ে গেছে। তাই অনেকেই সেই ডাল জাতীয় বীজ ডাল হিসেবে খাচ্ছেন।
কাজীপুর চাষী আব্দুল মালেকসহ কয়েকজন গম চাষি গাংনীর চোখ’কে জানান, তারা পনেরো দিন আগে গম বপন করেছেন। কিন্তু গমবীজ প্রণোদনা পেয়েছেন মাত্র তিনদিন আগে। কলাই চাষি কামারখালী গ্রামের আবুল হোসেনসহ কয়েকজন জানান, কলাই ও সরিষা আবাদ করা হয়েছে মাস খানেক আগে। অথচ সপ্তাহ খানেক আগে বীজ ও সার দেয়া হয়েছে। সার কাজে আসলেও বীজ কোন কাজেই আসবে না। শুধু এ মৌসুম নয়, প্রতি বছরই এভাবে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। ফলে সরকাদের স্বদিচ্ছা এখানে উপেক্ষিত। অন্যদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে।
একটি সুত্র জানায়, প্রণোদনা দেয়ার সময় সরকারী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা ঘটা করেই বিতরণ শুরু করেন কিন্তু মৌসুমের শুরুতে বীজ না দিয়ে কেন মাঝামাঝি সময়ে বীজ প্রদান করা হচ্ছে তা কেউ জানতে চান না। অপর একটি সুত্র জানায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রণোদনার বিষয়ে যাদের নামের তালিকা দেন তাদের অনেকেই প্রকৃত চাষি নন এবং বিত্তশালী। দলীয় ছাড়াও অনুগতদের মন রক্ষার্থে এই প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তবে জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদে চাষিদের নামের তালিকা রয়েছে। কে কোন ফসল চাষ করতে চান সে অনুযায়ি নামের তালিকা প্রদান করা হয়।
অপর একটি সুত্র জানায়, চেয়ারম্যান ও মেম্বরগনের অনেকেই ভুয়া চাষিদের নাম দিয়ে সার ও বীজ আত্মসাত করেন। এমন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে সাহারবাটি ইউপির জোড়পুকুরিয়া গ্রামের সাহাব মেম্বরের বিরুদ্ধে। তিনি চাষিদের নামের সার উত্তোলন করে নিজেই আত্মসাত করেন। বিষয়টি স্বীকার করেছেন কৃষি অফিস। তবে সাহাব মেম্বর অস্বীকার করে বলেছেন, কোন অনিয়ম করা হয়নি।
ধানখোলা ইউপির কয়েকজন চাষি গাংনীর চোখ’কে জানান, চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক তার নিজ গ্রাম চিৎলার চাষিদেরকে প্রণোদনায় নাম দিয়েছেন। অন্য গ্রামের চাষিরা এখানে উপেক্ষিত। বিশেষ করে মসূরী চাষিদের নাম দিয়েছেন নিজ অনুগত ও স্বজনদের নামে। এতে অন্যান্য চাষিরা ফুঁসে উঠেছেন। অনেকেই অভিযোগ নিয়ে এসেছেন কৃষি অফিসে। তবে চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক জানান, মাত্র ২০ জন চাষিকে মসূরী প্রণোদনা দেয়ার কথা। তাই মেম্বরদের মাধ্যমে তালিকা অনুযায়ি দেয়া হয়েছে। স্বজন প্রীতি বা নিজ গ্রামের কৃষকদের নামের তালিকার বিষয়টি সঠিক নয়।
গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার লাভলী খাতুন গাংনীর চোখ’কে জানান, প্রণোদনা দেয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অফিস পর্যন্ত চিঠি আসতে কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়। এতে একটু দেরী হয়। সেই সাথে বীজ আসতেও দেরি হয়েছে। তাছাড়া এ অঞ্চলের চাষিরা সব সময় আগাম আবাদে অভ্যস্ত তাই তারা আগে ভাগেই বীজ কিনে চাষ শুরু করেন। তিনি আরো জানান, চলতি মৌসুমে কলাই, মুগ, মসূর ও সরিষা বীজ বিতরণে একটু দেরী হয়েছে। অন্যান্য ফসলে কোন সমস্যা হবে না বলেও দাবী করেন তিনি।