কুষ্টিয়া পৌরসভার দুর্নীতি ফাঁস ১৪ লক্ষ টাকার ২০৩টি গাছ ১৬ বছর পর ১ লাখ ৬১ হাজার টাকায় বিক্রি
কুষ্টিয়ায় শহরের হাসপাতাল রোড সড়ক প্রশস্থকরন করতে ১৬ বছর আগে রোপন করা ২০৩টি গাছ এক লাখ ৬১ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে পৌরসভা। একেকটি গাছের দাম পড়েছে ৮০০ টাকার নিচে। অথচ স্থানীয় এক কাঠ ব্যবসায়ী বলছেন, প্রতিটি গাছ গড়ে ছয় থেকে সাত হাজার টাকায় বিক্রি করা যেত।
রাস্তা সংস্কারের জন্য কুষ্টিয়া হাসপাতাল সড়কের যে গাছগুলো কাটা হচ্ছে, সেগুলো নিলামে বাজার মূল্যের ছয় থেকে সাত ভাগের এক ভাগ টাকায় বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৬ বছর আগে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি হিসেবে রোপণ করা ২০৩টি গাছ দরপত্রের মাধ্যমে কিনেছেন এক লাখ ৬১ হাজার টাকায়। তবে গাছ ব্যবসায় জড়িত এক জন প্রতিবেদককে বলেন, এই গাছগুলোর একেকটির মূল্য ছয় থেকে সাত হাজার টাকা দাম হওয়া কথা। এই হিসাবে দাম হওয়ার কথা ১২ লাখ থেকে ১৪ লাখ টাকা। তবে ভ্যাট, কর ও অন্যান্য নানা শর্তের কারণে দাম কিছুটা কম হতে পারত। তাই বলে এতটা কম হওয়ার কথা না। এতে পৌরসভার পাশাপাশি ঠকেছে নিম্ন আয়ের স্থানীয়রা যারা সামাজিক বনায়নের আওতায় এই গাছগুলো রোপন করেছিলেন।
কারণ, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় যেসব বৃক্ষ রোপন করা হয়, সেগুলো বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যায়, তার ৭০ শতাংশ পাওয়ার কথা উপকারভোগীদের। এই হিসাবে এই এক লাখ ৬১ হাজার টাকার এক লাখ ১২ টাকার টাকার কিছু বেশি পাবে তারা। শহরের সাদ্দাম বাজার থেকে হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত এক কিলোমিটারের মতো সড়কের পাশের এই গাছগুলো কিনেছেন কুষ্টিয়া সদর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওয়াহিদ মুরাদ। তিনি বর্তমানে হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওয়াহিদ মুরাদ বলেন, ‘করোনার মধ্যে কোনো কাজ নেই। তাই এই টেন্ডারে অংশ নিয়েছি।’
এই গাছ বিক্রিতে প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করা হয় গত ২২ মার্চ। সে সময় সর্বোচ্চ দরদাতা ছিলেন ওয়াহিদ। তবে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে তিন হাজার টাকা কম হওয়ায় পৌরসভা তাকে গাছগুলো দেয়নি। দরপত্রে গাছগুলোর সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ৫৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ একটি গাছের দাম সরকার ঠিক করে মাত্র ৭৭৮ টাকা। ৮ এপ্রিল পরের দরপত্রেও সর্বোচ্চ দরদাতা ছিলেন ওয়াহিদ মুরাদ। এবার তিনি দাম দেন এক লাখ ৬১ হাজার টাকা। অর্থাৎ তিনি একেকটি গাছ কিনেছেন গড়ে ৭৯৮ টাকায় কিনেছেন। ওয়াহিদ মুরাদ আরো জানান, গাছগুলো কেটে নিতে পৌরসভা তাকে এক মাস সময় দিয়েছে। তিনি ১৭ এপ্রিল থেকে গাছ কাটা শুরু করেছেন।
কুষ্টিয়ার মিলপাড়া এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী আলম হোসেন মনে করেন, এত কম দামে বিক্রি করায় পৌরসভার ব্যাপক লোকসান হয়েছে। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘হাসপাতাল রোডের গাছগুলো দেখেছি। সাদ্দাম বাজার প্রান্তে কিছু কিছু বড় গাছ আছে সেগুলোর দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার উপরে। তবে কিছু গাছ আছে চিকন, ভালো বাড়েনি। সেগুলোর দাম খুব একটা বেশি হবে না। তাও সব মিলিয়ে গড় করলে একটি গাছের দাম ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পড়বে।’ অর্থাৎ এই গাছগুলোর যৌক্তিক দাম ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা হতে পারত বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
তবে যিনি গাছগুলো কিনেছেন, তিনি দাবি করছেন, তার খুব একটা লাভ হবে না। তিনি বলেন, ‘দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী সবগুলো গাছের শেকড় তুলে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে বেশ খরচ হবে। তাছাড়া ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে খরচ পড়ছে এক লাখ ৭৫ হাজার ছয়শ টাকা। তাই এসব গাছের কাঠ ও খড়ি বিক্রি করে খুব একটা লাভ হবে না।’ ২০৩টি গাছ এক লাখ ৬১ হাজার টাকায় বিক্রি করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকুও। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, গাছগুলোর মূল্য কোনো অবস্থাতেই ১০ লাখ টাকার নিচে হওয়ার কথা নয় তিনি টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সরওয়ার মুর্শেদ রতন মনে করেন, গাছ রেখেই সড়ক চওড়া করা যেত। যেটা যদি একান্তই সম্ভব না হয়, তাও যৌক্তিক দামে বিক্রি করে সে টাকা উপকারভোগীদের মধ্যে বিতরণ করা যেত। তিনি বলেন, ‘বিশেষ কোনো সুবিধার কারণেই ঠিকাদারকে কম দামে কাজ পাইয়ে দেয়া হয়ে থাকতে পারে।’
তবে কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রধান প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম দাবি করেছেন, তারা ভালো দাম পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমবার টেন্ডারে তিনজন অংশ নিলেও সবার দরই ছিল তাদের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম। পরেরবার যে দাম পেয়েছি তা আমি মনে করি ভালো।’ গাছগুলো রেখেই সড়ক সংস্কার করা সম্ভব ছিল না বলেও জানান এই কর্মকর্তা। বলেন, ‘হাসপাতালে রোগীদের যাতায়াতের জন্য সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ। গাছগুলো কাটার পর প্রথমে সড়কটি মেরামত করা হবে। এর খানাখন্দ বন্ধ করে কার্পেটিং করে দেয়া হবে। এরপর সড়কটি প্রশস্ত করার চিন্তা রয়েছে পৌরসভার। আগামী বছর মার্চের দিকে সেই কাজ হবে।’ তিনি বলেন, ‘এসব গাছ সামাজিক বনায়নের। উপকারভোগীদের সঙ্গে চুক্তি করে ১৬ বছর আগে রোপণ করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ১৫ বছর পেরুলে গাছ কেটে ফেলার কথা। এখান থেকে ৭০ শতাংশ টাকা পাবেন সমিতির উপকারভোগীরা। বাকি টাকা পৌরসভার।’
তবে বন বিভাগের পক্ষে বলা হয়েছে, সামাজিক বনায়নের এসব গাছ কাটতে তাদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। পৌরসভা সেটা করেনি। যশোর বন সার্কেলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করীম বলেন, বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন নয় এমন সড়ক ও জনপথ হতেও বনজদ্রব্য আহরণ, অপসারণ বা পরিবহনের জন্য ওই ভূমি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের ন্যূনতম জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বরাবর ফরম-৩ এ আবেদন করতে হবে। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকারের উপপরিচালকের আবেদনটি করার কথা। তবে পৌরসভা বা কোন কর্তৃপক্ষ এমন কোন আবেদন বা অবহিতপত্র দেননি বলে জানান কুষ্টিয়া সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ছালেহ মোঃ সোয়াইব খান। তিনি বলেন, ‘পৌর কর্তৃপক্ষ এই গাছগুলোর মূল্য নির্ধারণের জন্য বন বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল মাত্র।’