ঈদের দাওয়াত পত্র “ঈদকার্ড” আজ মেহেরপুর থেকে বিলুপ্ত প্রায়
ঈদ বয়ে আনুক আপনার জীবনে সুখ সমৃদ্ধি”
“ঈদের দাওয়াত তোমার তরে
আসবে তুমি আমার ঘরে
কবুল করো আমার দাওয়াত
না করলে পাব আঘাত
তখন কিন্তু দেব আড়ি
যাব না আর তোমার বাড়ি।
“ঈদ মোবারক”
হরেক রকম রঙের ও ডিজাইনের কাগজের ভাঁজে এ রকম গুটিকয়েক চরণ সম্বলিত কার্ড ঈদের দাওয়াত কার্ড বা ঈদ কার্ড নামে পরিচিত।
ঈদ কার্ড যে এক ধরনের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের ন্যায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৯০ এর দিকে যারা বেড়ে উঠেছে এবং শৈশব পার করেছে, তাদের কাছে ঈদ কার্ড আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার নাম। একটা সময় ঈদ এলেই যেন ঈদ কার্ড কেনার হিড়িক পড়ে যেত। কোথায় ঈদ কার্ড বিক্রি হয়, সেখানে ভিড় জমে উঠতো বেশ। আবার অনেকে কাগজের ব্যবহার শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে নিজে নিজে ঈদ কার্ড তৈরি করতেন।
সেকালে ঈদের পূর্বক্ষণে বন্ধু-বান্ধবদের ঈদের শুভেচ্ছা ও দাওয়াত দেওয়ার জন্য ঈদ কার্ড কেনাকাটার ধুম পড়ে যেতো, যেমনটি পড়তো ঈদের পোশাক কেনায়। মেহেরপুরের প্রতিটা শহরের মোড়ে মোড়ে মুদিখানার দোকান বা কোনো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার উদ্যোগে গড়ে তোলা কার্ড শপে সারি সারি হরেক ডিজাইনের ঈদ কার্ড পাওয়া যেত। ৩ টাকা থেকে শুরু করে ৩৫ টাকা বা ১২০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪০ টাকার ঈদ কার্ড সেসব দোকানে পাওয়া যেত। এর চেয়ে দামি ঈদ কার্ড বিক্রি হতো বড় কিছু শপিং মলে। সে অনেক পুরোনো কথা। আজকাল সেসব দোকান দেখা যায় না বললেই চলে।
কালক্রমে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের ডিজিটালাইজেশনের যুগে আগের মতো ঈদ কার্ড বিনিময় সেভাবে হয় না। জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ইলেকট্রনিক মেইল (ই-মেইল), মোবাইল এসএমএস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, মেসেন্জারসহ আরও অনেক কিছু। আর এই আধুনিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঈদকার্ডের মতো সেই আন্তরিকতা ও ভালোবাসার স্পর্শ কিন্তু নেই। যান্ত্রিকতার শহরে গ্রামবাংলার আবহমান এই সংস্কৃতি লোপ পেয়েছে।
এখন মানুষজন ঈদ কার্ড বিনিময়কে সময়ের অপচয় ভাবতে শুরু করেছে। কারণ মোবাইল বা কম্পিউটারের কি প্যাডের বর্ণগুলো চাপ দিয়ে ছোট্ট বার্তা লিখে পাঠিয়ে দিতে বেশি সময় লাগে না। কার্ড কেনা, কিছু কথা লেখা, কোনো ঠিকানায় পৌঁছানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে অনেকেই মনে করছেন এখন।
শুভেচ্ছা ও দাওয়াত বিনিময়ের মাধ্যম আরও সহজ করে দিয়েছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঈদ সম্পর্কিত অগণিত শুভেচ্ছা বার্তা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে পছন্দমতো বার্তা বাছাই করে মোবাইলে সংরক্ষিত সব যোগাযোগ নম্বর সিলেক্ট করে তড়িৎ গতিতে সবার কাছে ঈদের শুভেচ্ছা পাঠানো যায়।
আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট এবং ইনবক্সে মেসেজিংয়ের জন্য ঈদ কার্ডের ছবি বা পোস্টার প্রয়োজন। সেটিও ইন্টারনেটের বদৌলতে সহজ হয়েছে। স্মার্টফোনের জন্য বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) তৈরি করেছে অনেকে। সেই অ্যাপগুলোতেও আগে প্রস্তুত করা অসংখ্য পোস্টার পাওয়া যায়।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা শহরের বাসস্ট্যান্ড বাজারের ভ্যারাইটি স্টোরের নূরুল ইসলাম ও মিজান ভাই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদ কার্ড বিক্রি করতেন, নূরুল ইসলাম জানালেন ঈদ কার্ড বিক্রির অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, সে সময় দোকানে ঈদ কার্ড কেনার হিড়িক পড়ে যেতো। কেউ চাইতো কাবা শরিফ, মক্কা শরিফের ডিজাইন করা কার্ড। কেউবা কার্টুনখচিত ডিজাইন কিনতো। গ্রাহকদের কার্ড কেনার প্রাণবন্ততা মনোমুগ্ধকর ছিল বলে জানান তিনি।
ভ্যারাইটি স্টোর থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া কনক স্টোরের মিজান ভাই জানালেন আরও কিছু কথা। তিনি বলেন, ঈদ কার্ডের প্রচলন একেবারেই নেই বললে ভুল হবে। তা ছাড়া বড় বড় কিছু শপিং মলে বাহারি রকমের কার্ড পাওয়া যায়, তবে ক্রেতার আগ্রহ কমে যাওয়ার কথা তার কথায় প্রতীয়মান হয়।
বিজ্ঞান আমাদের বেগ দিলেও কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এই বেগ চলমান থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে গিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করবে, আব্বু এটা কী? তখন আব্বু উত্তর দেবেন, এটা হলো ঈদ কার্ড।