“অদম্য শেখ হাসিনার অনন্য অর্জন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের নব নব অসার তত্ত্ব”
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে শত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে নির্মিত হয়েছে বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এর সুফল ভোগ করছে দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ। স্বাধীনতার পর থেকে এই অঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্ন ছিল ‘পদ্মা সেতু’। অবশেষে প্রায় অর্ধ শতকের স্বপ্ন আর অপেক্ষার অবসান হয়েছে তাদের। প্রমত্তা পদ্মা নদীর বুক ভেদ করে দৃশ্যমান হয়েছে অনন্য নির্মাণশৈলীর দৃষ্টিনন্দন পদ্মা সেতু। গত ২৫ জুন প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের উপস্থিতিতে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুগ যুগ ধরে ফেরি পারাপারের চরম দূর্ভোগ আর কষ্টের অবসান হয়েছে এ অঞ্চলের কোটি মানুষের। এ কারনে তাদের মনে এখন সীমাহীন আনন্দ আর বাঁধভাঙা উল্লাস। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন পরবর্তী মিলিয়ন মানুষের জনসভায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। পদ্মা সেতু মানুষের কাছে যে কতটা আবেগের তা আমি অনুভব করেছি তাদের অপার আনন্দ আর উচ্ছ্বাস দেখে।
বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় জাতীয় সংসদে পদ্মা সেতু নির্মাণের দাবি তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মাদারীপুরের সংসদ সদস্য ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরি। বঙ্গবন্ধু সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে সম্মত ছিলেন। তবে স্বল্পমেয়াদি ঐ সরকার সেতু নির্মাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নি। তবে কন্যা শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম মেয়াদে ১৯৯৯ সালে প্রাক–সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূত্রপাত করেন। ২০০১ সালের ৪ জুৃলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সমীক্ষা শেষে ২০০৫ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রাথমিক প্রাক্কলন ধরা হয় ১২,০০০ কোটি টাকা। তবে ঐ সরকারের উদাসীনতার কারনে তারা ডিপিপি অনুমোদন করে যেতে পারেনি। পরবর্তীতে ওয়ান-ইলেভেন সরকার বিশদ নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ২০০৭ সালে দরপত্র আহ্বান করে এবং সেতু নির্মাণে একটি ডিপিপি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদন দেয়। তখন ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ডিপিপিতে ২০১৫ সালের মধ্যে সেতু নির্মাণের লক্ষ্য ঠিক করা হলেও ঐ সরকারের আমলে সেতু নির্মাণের কাজ আর অগ্রসর হয়নি।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মাত্র ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হওয়ায় পরের বছর জানুয়ারিতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫.৫৮ কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি করে ৬.১৫ কিলোমিটার করা হয়। প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে মাত্র তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নকশা করা হয়েছিল। পরে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে বেশি ভার বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন রেল সংযোগ যুক্ত করা হয় যা বিএনপি বা ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় করা ডিপিপিতে ছিল না। কংক্রিটের বদলে ইস্পাত বা স্টিলের অবকাঠামো যুক্ত হয় সংশোধিত ডিপিপিতে। সেতু নির্মাণে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি গভীরতা ধরা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং জমি অধিগ্রহন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। পদ্মা সেতুতে নদী শাসন করতে হয়েছে ১৪.৫ কিলোমিটার যা নজিরবিহীন। সংশোধিত ডিপিপিতে সেতুর ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে এসব কারণ উল্লেখ করে সেতু বিভাগ।
নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এর সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। প্রায় একই সময়ে দেশের নোবেল বিজয়ী ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস কে গ্রামীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত তার বয়সজনিত আইনি বাধার কারনেই তাকে গ্রামীন ব্যাংকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গিয়ে হেরে যান নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে নাখোশ হন তিনি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে ফোন আসে আমেরিকার প্রভাবশালী পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনের। কিন্তু অনড় প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ তার নেই। আমেরিকায় বসবাসকারী প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে হুমকি দেওয়া হয় তার মাকে চাপ দিতে- যাতে ইউনুসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হয়। তার বিরুদ্ধে অডিট করার হুমকি দেওয়া হয় ওবামা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা কোনো চাপের কাছেই মাথানত করেন নি।
কথিত আছে এ কারনেই ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের প্ররোচনায় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের দাবির মুখে সরকার সে সময়কার যোগাযোগ মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা এবং যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের সচিবকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। যোগাযোগ সচিবকে আসামি করে মামলা ও করেছিল দুদক। তিনি জেল ও খাটেন অনেকদিন। তারপর ও বিশ্বব্যাংক সহ একে একে অন্যান্য সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করেন। কানাডার টরেন্টোর আদালত এবং বাংলাদেশের দূর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে সে সময় দূর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অথচ বিশ্বব্যাংক সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের পূর্বের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, যা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ বলেই এদেশের সিংহভাগ মানুষের বিশ্বাস।
শেখ হাসিনা জানতেন, বিশ্ব ব্যাংকের দূর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিলের উছিলা মাত্র। তারা কোনোভাবেই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না। সে কারনে ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রীপরিষদের এক বৈঠকে সবাইকে তাক লাগিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসি সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মত এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেকের মনে শঙ্কা থাকলেও উন্নয়নকামী স্বাধীনচেতা বাঙালি শেখ হাসিনাকে বিপুলভাবে সমর্থন দেন। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ১২ ই ডিসেম্বর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিজনিত কারনে প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা। সেতুর দুই পাড়ে প্রায় ১৪.৫ কিলোমিটার নদী শাসন করতেই ব্যয় হয় প্রায় ৯,০০০ কোটি টাকা। পৃথিবীর আর কোনো সেতুর ক্ষেত্রে নদী শাসনে এত ব্যয় হয় নি। দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে বিএনপি সহ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সেতু নির্মাণের শুরু থেকেই কাল্পনিক দূর্নীতি, অধিক নির্মাণ ব্যয় সহ বিভিন্ন অযৌক্তিক বিষয়কে সামনে এনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগেন। বিশ্বব্যাংক সহ অন্যান্য দাতা সংস্থার পক্ষাবলম্বন করেন তারা।
বিশ্বব্যাংক সহ দাতা সংস্থাগুলোর পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের পর দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া প্রকাশ্য জনসভায় শেখ হাসিনার সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবেনা বলে মন্তব্য করেন। তবে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সেতুর কাজ শুরু করলে- জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে এরুপ হাস্যকর দাবি করে দেশের মানুষকে পদ্মা সেতুতে উঠতে নিষেধ করেন। উঠলে ভেঙে পড়বে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। লোড ক্যাপাসিটি, ভূমিকম্প সহনীয়তা সহ সবদিক বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম সেরা এই স্থাপনার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের জুৃলাই মাসে সরকারবিরোধী চক্রের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ায়। পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালায় ঐ অপশক্তি। সরকারের সেতু বিভাগ বিষয়টিকে গুজব বলে জনগণকে বিভ্রান্ত না হতে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন। তখন গুজবের কারনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা ও অপহরণকারী সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে পিটিয়ে মারার মত ঘটনাও ঘটে।
অবশেষে শত চ্যালেঞ্জ, প্রতিবন্ধকতা এবং ষড়যন্ত্রকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে অদম্য শেখ হাসিনা সরকার জাতিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় খরস্রোতা পদ্মা নদীর বুক ভেদ করে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাঙালির গর্বের পদ্মা সেতু। গত মাসের ২৩ জুন সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় এবং ২৫ জুন উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুঁড়ির দেশ নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক দেশের নাম। পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে আমাদের আত্মসম্মানবোধকে সমুন্নত করেছেন, আমাদের সক্ষমতার জানান দিয়েছেন। অথচ সেতু উদ্বোধনের পরও বিএনপি সহ সরকার বিরোধী কিছু রাজনৈতিক সংগঠন সরকারকে সাধুবাদ না জানিয়ে বরং কোথায় সেতুর নাট-বল্টু লুজ আছে সেসব প্রচারে ব্যস্ত।
তারা মাত্র ১২০ টন লোড ক্যাপাসিটির ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সাথে ১০,০০০ টন লোড ক্যাপাসিটির পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের তুলনা করে পদ্মা সেতু নির্মাণে দূর্নীতির আষাড়ে গল্প শোনায়। পদ্মা সেতু পৃথিবীর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মার উপর নির্মিত। অন্যদিকে ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের উপনদী লোহিত নদীর উপরে। ‘ভূপেন হাজারিকা’ সেতুর দীর্ঘতম স্প্যান ৫০ মিটার এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এবং বিখ্যাত চীনের ‘বেইজিং গ্রান্ড ব্রীজ’ এর স্প্যানের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য যেখানে ৪৪ মিটার সেখানে পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার! অর্থাৎ তিন গুন। আবার পৃথিবী বিখ্যাত ক্যালিফোর্নিয়ার ‘গোল্ডেন গেট ব্রীজ’ এর পিলারের গভীরতা মাত্র ১৯.৮১ মিটার! এবং ‘সিডনী হার্বর ব্রীজ’ এর পিলারের গভীরতা যেখানে ৮৯ মিটার সেখানে পদ্মা সেতুর পিলারের গভীরতা ১২২ মিটার! এত দীর্ঘ গভীরতায় পিলার পৃথিবীর আর কোনো সেতুতে নেই। যা সেতুটিকে অনন্যতা দান করেছে।
ভারতের গঙ্গা (পদ্মা) নদীর উপর ১৯৭২-‘৮২ পর্যন্ত নির্মিত মহাত্মা গান্ধী সেতুর নির্মাণ ব্যয়ও শুরুতে ধার্যকৃত ব্যয় থেকে প্রায় দ্বিগুন বেড়ে যায় (৪৬ কোটি রুপি থেকে ৮৭ কোটি রুপি)। কারন প্রকল্প শেষ হওয়ার মেয়াদ ৭৮-৮২ অর্থাৎ চার বছর বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয় ও সে সময় বেড়ে যায়। অথচ পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ ৭ বছর বাড়ার কারনে নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে দেড় গুন। কাজেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি কতটুকু অযৌক্তিক? আর মূল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ১০,১৬১ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১২,১৩৩ কোটি। অর্থাৎ বেড়েছে প্রায় ২০০০ কোটি টাকা যা সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় কমই বলা চলে। মহাত্মা গান্ধী সেতু নির্মাণের ৩৮ বছরের মাথায় ২০২০ সালে কেবল এর মেরামত বাবদ খরচ হয়েছে ১৭৪২ কোটি রুপি যা নির্মাণ ব্যয়ের ও ২০ গুনের বেশি! প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে নির্মাণ ব্যয় কতটা বাড়তে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভারতের মহাত্মা গান্ধী সেতু।
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোর ৭.১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ওকল্যান্ড বে ব্রীজ’ পূনর্গঠনে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ০.২৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০০২ সালে শুরু হয়ে ২০১৩ সালে শেষ হওয়া পূনর্গঠন কাজে ব্যয় হয়েছিল ৬.৩ বিলিয়ন ডলার! অর্থাৎ আনুমানিক ব্যয়ের তুলনায় ২৫ গুনের ও বেশি! পদ্মা সেতুর ন্যায় ওকল্যান্ড বে ব্রীজ পূনর্গঠনে ও বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় কিন্তু ২৫ গুন বাড়ে নি, বেড়েছে দেড় গুন। পদ্মা সেতুর তুলনায় মাত্র ১ কিলোমিটার বেশি দীর্ঘ এই ব্রীজের শুধুমাত্র পূনর্গঠনে ব্যয় হয়েছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুন! অথচ বিএনপির মাননীয় সাংসদ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানারা সংসদে এসব তথ্য দেন না। নির্মাণশৈলীতে অনন্য পদ্মা সেতুর তুলনা করেন ভারতের সাধারন মানের ভূপেন হাজারিকা সেতুর সাথে। এটি হয় তাদের জ্ঞানের নয়তো মনের দৈন্যতা।
অনুমান করা হচ্ছে যে এই সেতুর
টোল বাবদ যে আয় হবে, শুধু তা দিয়ে
সেতুর ব্যয় উঠে আসতে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৯ বছর। বিশ্বব্যাংকের বরাতে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা জানায়, আগামী ৩১ বছরে যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে ১৮.৫ বিলিয়ন ডলার, যা নির্মাণ খরচের ৫.৫ গুণ। এ ছাড়া সামাজিক অগ্রগতি অর্থনীতিতে যোগ করবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। দুই পাড়ে নদী শাসনের মাধ্যমে যে জমি রক্ষা হয়েছে তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ইন্টারনেট লাইন গিয়ে সাশ্রয় করবে ২,৪০০ কোটি টাকা। ফেরি চলাচল না হওয়ায় খরচ সাশ্রয় হবে ৩,৬০০ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী সেতু কর্তৃপক্ষ আগামী ৩৫ বছরে ১% মুনাফায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করবে অর্থ মন্ত্রনালয়কে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টোল থেকে আদায়কৃত অর্থ এর বেশিরভাগ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হবে এবং বাকি অর্থ দিয়ে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।
অনন্য নির্মাণশৈলীর পদ্মা সেতু কেবল স্টীল, পাথর, রড, সিমেন্ট আর কংক্রিটের এক স্থাপনা নয়, এটি দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন, সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ সোপান। ১৬ কোটি বাঙালির সক্ষমতা আর আত্মমর্যাদার প্রতীক। শেখ হাসিনার অদম্য সাহসি নেতৃত্বের অনন্য অর্জন। এ সক্ষমতা ষড়যন্ত্রকারী, অপপ্রচারকারী গোষ্ঠীর মুখে কেবল চপেটাঘাত নয়, তাদের নিদারুণ পরাজয় আর অদম্য শেখ হাসিনার হাত ধরে আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতির সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যাওয়ার চূড়ান্ত হাতছানি!
লেখকঃ মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা, গাংনীর সন্তান।